সাইবার পেট্রোল: কে ধরবে বাংলাদশের ঢাল?


তানভীর হাসান জোহা
২৯ জুলাই, ২০২৫ ১০:৫৬  
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৯:১৯  
সাইবার পেট্রোল: কে ধরবে বাংলাদশের ঢাল?

বদলে গেছে বিশ্ব। এক সময় আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি আসতো রাস্তা-ঘাটে। এখন সেই হুমকি আসে ফোনের পর্দা থেকে। লড়াই শুধু লাঠি বা বন্দুক দিয়ে হয় না; হয় হ্যাশট্যাগ, লাইভ ভিডিও এবং সুপরিকল্পিত গুজব দিয়েও। তাই ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার পেট্রোল জোরদার করার সাম্প্রতিক নির্দেশনাগুলো সময়োপযোগী। পুলিশ সতর্ক করেছে—কিছু উগ্রবাদী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনলাইন গ্রুপ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অস্থিরতা ছড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এই উদ্বেগ তাই যথার্থ।

সাইবার পেট্রোলের খুঁটিনাটি

সাইবার পেট্রোল মানে শুধু ফেসবুক স্ক্রল করা নয়।
এটা এমন এক পদ্ধতি যেখানে প্রযুক্তি এবং মানব বুদ্ধিমত্তা একসঙ্গে কাজ করে।
এ জন্য প্রয়োজন-

  • সন্দেহজনক ক্যাম্পেইন শনাক্ত করতে কিওয়ার্ড ট্র্যাকিং করা স্মার্ট সফটওয়্যার
  •  হাজার হাজার পোস্ট বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিক আচরণ শনাক্ত করা এআই টুল
  •  এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ এবং ওয়েবের গোপন প্রান্তগুলোতে নজর রাখা
  •  ছবি ও ভিডিও যাচাই করে উৎস ও পোস্টকারীর পরিচয় শনাক্ত করা

কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি সত্যিই এসব করার পূর্ণ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রাখি?
এবং কে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবে—বিটিআরসি, এনটিএমসি, নাকি পুলিশ?

নেতৃত্বের প্রশ্ন

উত্তর হলো, তিন সংস্থারই ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু নেতৃত্বের বিষয়টি স্পষ্ট হতে হবে। কেননা-

বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) নেটওয়ার্ক ও অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ব্যাকবোন লেভেলে ব্লক, ফিল্টার ও ট্রেস করতে পারে, কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রক, অনুসন্ধানকারী নয়।
এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার)।-এর রয়েছে উন্নত লফুল ইন্টারসেপশন ও ডাটা অ্যানালাইসিস টুল। তারা দেশব্যাপী ডিজিটাল সিগন্যাল ট্র্যাক করে গোয়েন্দা তথ্য তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাঠাতে পারে।
পুলিশ (সাইবার ইউনিট) একমাত্র বাহিনী যাদের তদন্ত, গ্রেফতার এবং আদালতে প্রমাণ উপস্থাপনের আইনি ক্ষমতা রয়েছে।

তাই, এই তিনটি সংস্থা যদি আলাদাভাবে কাজ করে, তবে সাইবার পেট্রোল সফল হবে না।
এনটিএমসি নজরদারি করবে, বিটিআরসি প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে, কিন্তু পুলিশকেই তদন্ত ও প্রতিক্রিয়ার নেতৃত্ব দিতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া তথ্য স্ক্রিনে থাকবে, কিন্তু তা মাঠের নিরাপত্তায় রূপান্তরিত হবে না।

ডিজিটাল নেটওয়ার্কের বাস্তব প্রভাব

আজকের বিশ্বে, অন্য দেশে বসে কিছু লোক মাত্র একটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে এখানকার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে পারে। “ভার্চুয়াল স্কোয়াড” নামের কিছু গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও এনক্রিপ্টেড চ্যানেল ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়। তাদের অনলাইন বার্তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাস্তব মাঠে বিশৃঙ্খলায় পরিণত হতে পারে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ?

তাই, সাইবার পেট্রোল শুধু একটি টুল নয়—এটা এক ধরনের ঢাল। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগাম সংকেত দেখতে দেয়, যাতে বিশৃঙ্খলা বাস্তবে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

এগুতে হবে সামনে 

এই চলমান অভিযান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি মনে করিয়ে দেয়—সাইবার সিকিউরিটি কোনো এক সপ্তাহের অভিযান নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী অঙ্গীকার।

  • আধুনিক এআই-চালিত বিশ্লেষণ টুলে বিনিয়োগ করতে হবে
  • সাইবার তদন্তের জন্য নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষিত করতে হবে- এবং
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিটিআরসি, এনটিএমসি ও পুলিশের মধ্যে যৌথ কমান্ড ও স্পষ্ট দায়িত্ববন্টন গড়ে তুলতে হবে

আজকের দিনে রাস্তা ও ডিজিটাল বিশ্ব গভীরভাবে সংযুক্ত। একটিকে সুরক্ষিত করতে চাইলে, অন্যটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।


লেখকঃ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। তিনি আইন, প্রযুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে লেখালেখি করেন।


দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।