বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) গঠনমূলক ভূমিকা 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য এআই চ্যালেঞ্জ


এ এইচ এম বজলুর রহমান
২৬ জুলাই, ২০২৫ ১৭:২৪  
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৯:২০  
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য এআই চ্যালেঞ্জ

২০২৫ সালের ২৬ জুলাই, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন আসন্ন ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অপব্যবহার সম্পর্কিত সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সতর্ক করেন। তিনি নির্বাচন কমিশনকে "প্রযুক্তি-নির্ভর হস্তক্ষেপের" বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকতে আহ্বান জানান এবং এর মোকাবেলায় উদ্ভাবনী সমাধান ও প্রস্তুতি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন।

ঝুঁকি কমাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): সতর্কতা ও সম্ভাবনার দ্বৈত আহ্বানটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের নিরিখে তাহলে এবার একটু চিন্তা করে দেখা যাক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। 

ডিপফেইক ও ভুয়া তথ্য
জেনারেটিভ  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর অগ্রগতির ফলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ভুলভাবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তিকর অডিও, ভিডিও ও ছবি তৈরির ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে বিরোধী নারী নেত্রীদের অবমাননাকর প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা AI-নির্ভর ডিপফেইকের পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সাধারণ জনগণের জন্য গণমাধ্যম সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি অপরিহার্য, যাতে তারা সত্য ও ভুয়া তথ্য পার্থক্য করতে পারে।

লক্ষ্যভিত্তিক যোগাযোগ কৌশল
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  ব্যবহার করে শ্রোতাদের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজন করে প্রাসঙ্গিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তবে এটি দায়িত্বশীল ও নৈতিকভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে শহর ও গ্রামসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সঠিক তথ্য পৌঁছায় এবং সচেতন ভোটার তৈরি হয়। মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ এই কাজে সহায়ক হতে পারে।

নির্বাচনী তথ্য পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন
ভুল তথ্য মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। ভোটারদের ভোটকেন্দ্র, ভোটগ্রহণের তারিখ ও ফলাফল গণনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে AI-চ্যাটবট ও অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে পারে। এতে বিভ্রান্তি কমবে এবং ভোটারদের আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়বে।

স্বচ্ছতা বজায় রাখতে কৃত্রিম সত্তা শনাক্তকরণ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা   দিয়ে তৈরি নকল পরিচয় বা সোশ্যাল বট স্বচ্ছতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলে দায়বদ্ধতা বাড়ানো এবং বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বরকে জোরদার করা প্রয়োজন।

সাইবার হুমকি মোকাবেলায় নির্বাচন অবকাঠামো সুরক্ষা
যদিও বাংলাদেশে এখনো সীমিতভাবে অনলাইন বা ব্লকচেইন ভোটিং রয়েছে, তবুও সম্পূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করা জরুরি। ভোটার তথ্য অ্যাপ ও অন্যান্য ডিজিটাল সেবা যাতে সাইবার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সহনশীলতা ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে

মিডিয়া সাক্ষরতা বাড়াতে হবে
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত কনটেন্ট যাচাই করার দক্ষতা জনগণের মধ্যে বিস্তৃত করতে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে
রাজনৈতিক বিভাজন ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা উৎসাহিত করা দরকার, যাতে সচেতন এবং সহনশীল ভোটার সমাজ গড়ে ওঠে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক আইন প্রণয়ন
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং একইসাথে দায়বদ্ধতাও বজায় রাখে, সে লক্ষ্যেই আইন সংশোধন প্রয়োজন।

সম্ভাব্য পরিণতি
গণআস্থা নষ্ট হওয়া: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  নির্ভর বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট প্রচারের ফলে গণমাধ্যমের উপর জনগণের আস্থা নষ্ট হতে পারে।

ভোটার আচরণ প্রভাবিত হওয়া: ভুল তথ্য ভোটারদের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বা পুরোপুরি ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারে।

গণতান্ত্রিক বিতর্ক দমন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর কুৎসা রটনার কারণে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন বা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

কার্যক্রমে বিভ্রান্তি: ভুয়া বট ও সাইবার হামলা ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

ব্যাঘাত মোকাবিলায় কৌশল

মিডিয়া সচেতনতা
•    ভুয়া ভিডিও, কৃত্রিম কণ্ঠ ও চিত্র শনাক্ত করতে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
•    সংবাদমাধ্যমকে  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  উৎপাদিত সন্দেহভাজন কনটেন্ট যাচাইয়ের জন্য উৎসাহ দিতে হবে।

স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ
•    সোশ্যাল মিডিয়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  উৎপাদিত কনটেন্ট লেবেলিং, উৎস শনাক্তকরণ ও শনাক্তকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।

•    আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃত্রিম বিভ্রান্তিকর প্রচার বন্ধে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

প্রযুক্তিগত সহনশীলতা
•    নির্বাচন সংক্রান্ত অ্যাপ ও নেটওয়ার্কের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা।
•    বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন বা ই-ভোটিং প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় ডেটা সুরক্ষা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সিভিল সোসাইটি ও আন্তঃখাত সহযোগিতা
•    নির্বাচন কমিশন, প্রযুক্তি সংস্থা, গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা।
•    স্বাধীন পর্যবেক্ষক দল গঠন করে রিয়েল-টাইমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  ভিত্তিক ভুয়া তথ্য শনাক্ত ও প্রতিরোধ করতে হবে।


বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  যেমন একটি অভূতপূর্ব সম্ভাবনা, তেমনি এটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিভ্রান্তিকর ডিপফেইক, টার্গেটেড মিথ্যা প্রচার, ভুল ভোট তথ্য ও কৃত্রিম বট ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেমন সতর্ক করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  ভিত্তিক হুমকি কখনো কখনো অস্ত্র থেকেও বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।

তাই শিক্ষা, আইন, গণমাধ্যম, সাইবার নিরাপত্তা ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং জনগণের মতপ্রকাশের বৈধতা মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।


লেখকঃ ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)। 


দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।