ফের গোপালগঞ্জ ঘিরে রাতভর গুজব!

২০২৪ সালের ১০ জুলাই গোপালগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিক্ষোভকারীদের হামলায় ৯ সেনাসদস্য আহত, সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ দুটি গাড়ি ভাঙচুর ইত্যাদি গুজবে সয়বলাব ছিলো সোশ্যাল হ্যান্ডেল। ঠিক এক বছর পর ফের গুজবের কেন্দ্রে এলো একই নাম। অবশ্য এবার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে একটি রিলস শেয়ার করে শুরুতেই ধরা পড়ে গেছেন সজীব ওয়াজেদ। নিজের ভেরিফায়েড সোশ্যাল হ্যান্ডেলে ১৬ জুলাই রাত ১০টায় ব্রহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ শেয়ার করে পুলিশ নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের গুলি করছে বলে দাবি করে ফেঁসে গেছেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের এই আইসিটি উপদেষ্টা।
পোস্টটি ছড়িয়ে পড়ার পরই গুজবটি সনাক্ত করে ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশির প্রকৃত ভিডিওটি শেয়ার করেন। তোপের মুখে নিজেই গুজবের ওই পোস্টটি ডিলিট করেছেন জয়। তবে তার ওই গুজবটি ভাইরাল হয়ে গেছে সজীব কেল্লা হ্যাশট্যাগে।
এদিকে গোপালগঞ্জের গুজবের রাতেই ভাইরাল ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ছবি’ অনেকে গোপালগঞ্জের ১৬ জুলাইয়ের বলা হলেও ফ্যাক্টচেকার শিশির জানিয়েছেন, ছবিটি ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের। অবশ্য আজ গোপালগঞ্জেও সশস্ত্র আওয়ামীলীগারদের দেখা গেছে একাধিক ভিডিওতে।
ওদিকে ‘গুজববাজ আওয়ামীলীগের আজকে গোপালগঞ্জে ছড়ানো গুজবের ভিডিও’ শেয়ার করে সবাইকে সতর্ক করেছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ।
গুজব নিয়ে সতর্কমূলক পোস্টে এনসিপি নেতা সার্জিস আলম তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “গোপালগঞ্জ থেকে এক ভাই মেসেজ দিয়েছে- "ভাই অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসবে কান দিয়েন না। আমরা গোপালগঞ্জের মানুষ একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেছি- খারাপ সময়ে শেখ হাসিনা সবার আগে নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে সেফ জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর নিজে সেফ জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু আমাদেরকে, আমাদের পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ফেলে গেছে। সুবিধা নিয়েছে গুটিকয়েক মানুষ কিন্তু ভুক্তভোগী আমরা সবাই।যে আমাদের কথা চিন্তা করেননি, তার কথা আমাদের চিন্তা করার সময় নাই। আমরা এতটা বলদ না যে- তার কথায় এখনও মানুষকে প্রতিপক্ষ বানাবো, আপনাদের মুখোমুখি দাঁড়াবো, জীবনটাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিব! আপনারা আপনাদের মত করে প্রোগ্রাম করেন। চিন্তার কোন কারণ নাই।"
এমন পরিস্থিতিতে গোপালগঞ্জের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক পুরোনো ও ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন ছবি পোস্ট করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
রাতেই ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টচেক জানায়, ‘১৬ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে গোপালগঞ্জের সংঘর্ষ নিয়ে নানা পোস্ট ছড়ানো হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল এ দিনের সহিংস ঘটনার মনগড়া বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, একটি সংগঠিত প্রোপাগান্ডা অভিযানের অংশ হিসেবে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগপন্থীরা পুরোনো ও ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন একাধিক ছবি শেয়ার করেছেন, যা ওই দিনের সহিংসতার দৃশ্য বলে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস. এম. জাকির হোসেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনসহ কয়েকজন ব্যক্তি ছবি পোস্ট করে দাবি করেন, ‘ইউনূস গ্যাং’ এবং বিরোধীদলীয় কর্মীরা সাধারণ মানুষকে হিংসাত্মকভাবে আক্রমণ করছে।
একটি ছবিতে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন এক আহত কিশোরকে বহন করছে; পেছনে আগুন জ্বলছে এবং উত্তেজিত জনতা রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। ছবিটি গোপালগঞ্জে ঘটে যাওয়া সহিংসতার নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে-এই ছবিটি ১০ আগস্ট ২০২৪ সালের একটি ভিন্ন ঘটনার।
আরেকটি বহুল প্রচারিত পোস্টে দেখা যায়, জাকির হোসেন এবং আশরাফুল আলম খোকন একটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক কর্মকর্তা বিক্ষোভকারীদের দিকে গুলি ছুড়ছেন।
প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এসব পোস্টে ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। পোস্টে তারা উল্লেখ করেন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন এবং এনসিপি নেতা-কর্মীদের উসকানিতে এই সহিংসতা শুরু হয়।
‘বাস্তবতা হলো, ছবিটি ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপি সমাবেশের সময়ের, যেখানে ডিবি কর্মকর্তা কনককে জনতার দিকে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়।’
জাকির হোসেন আরেকটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। তিনিও দাবি করেন, এটি গোপালগঞ্জের আজকের সংঘর্ষের ফলাফল।
‘তবে এই ছবিটিও ভিন্ন ঘটনার,’ প্রেস উইং দাবি করে, ‘ছবিটি ২০ মার্চ ২০২৩ সালে এক সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনার সময় তোলা হয়েছিল।’
একই ভুয়া প্রচারণার অংশ হিসেবে একটি শিশুর ছবি ছড়ানো হয়-যেখানে তাকে লাঠি হাতে দেখা যায়। দাবি করা হয়, ছবিটি ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে তোলা এবং ওই শিশু নাকি সহিংসতায় অংশ নেয়।
ছবিটি এই মিথ্যা বার্তা ছড়াতে ব্যবহার করা হয় যে, রাজনৈতিক সহিংসতায় শিশুদের পর্যন্ত জড়ানো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ছবির একটি ডিজিটালি সম্পাদিত (সম্ভবত এআই-নির্মিত) সংস্করণ শেয়ার করেন নিঝুম মজুমদার, যিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একজন অনলাইন প্রোপাগান্ডিস্ট হিসেবে পরিচিত বলে প্রেস উইং দাবি করেছে।
‘আসলে, শিশুর এই ছবিটি গোপালগঞ্জে তোলা হয়নি, বরং গাজীপুরের সফিপুর এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট। মূল ভিডিওটি ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল।’
এসব বিভ্রান্তিকর ছবির পাশাপাশি, আওয়ামী লীগপন্থী অ্যাকাউন্টগুলো ভিত্তিহীনভাবে দাবি করে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নাকি বেসামরিক মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
এইসব মিথ্যা প্রচারণা জনমতকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়। প্রেস উইংয়ের মতে, এসব ভুয়া প্রচারণা ও যাচাইকৃত সূত্রভিত্তিক তথ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে।
আজকের সহিংসতা শুরু হয়, যখন গোপালগঞ্জ শহরে নির্ধারিত সমাবেশ শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতাদের বহর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকরা আক্রমণ করে।
এই আক্রমণ দ্রুত বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়।
সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের গাড়ির পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) একটি গাড়িও আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, ১৬ জুলাই রাত ৮টা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কঠোর কারফিউ জারি করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মাঠের বাস্তব ঘটনার বিপরীতে, আওয়ামী লীগপন্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর, প্রাসঙ্গিকতা-বর্জিত ও মনগড়া ছবি ছড়িয়ে টাইমলাইন ভরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।’