বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে অ্যাপ বানিয়ে হুমকির মুখে উদ্ভাবক

১৬ জুন, ২০২৫  
১৬ জুন, ২০২৫  
বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে অ্যাপ বানিয়ে হুমকির মুখে উদ্ভাবক

পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে তেল নিয়ে তেলেসমাতি; ডিম নিয়ে অশ্ব ডিম্ব ঘটনা; পেঁয়াজে ঝাঁঝে মরিচের কান্না- বিষয়গুলো আমাদের দেশে নতুন নয়। এভাবেই নিত্যপণ্য নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের অসন্তোষ  চরমে ওঠে, ঠিক তখনই বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে অভিনব একটি উদ্যোগ নেন এক তরুণ। প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে উৎপাদক-বিক্রেতা ও ভোক্তার মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টিতে তৈরি করেন একটি অ্যাপ। অ্যান্ড্রয়েড এই অ্যাপটির নাম ‘বাজারদর’। 

অ্যাপটি দেশের নাগরিকদের ন্যায্য পণ্যমূল্য জানাতে সহায়তা করবে এবং বাজারে কারসাজি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বিবেচনায় ইতিমধ্যেই এটি নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগামী ২৩ জুন অ্যাপটি সবার জন্য উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (DNCRP)। গত ২৩ এপ্রিল অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোরে দেয়ার পর এটি এরই মধ্যে ৩+ র‌্যাংকিং নিয়ে হাজেরর বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।   

কিন্তু অ্যাপটি গুগল থেকে মুছে ফেলতে অ্যাপ নির্মাতা মোঃ ইব্রাহিম মোল্লা-কে ফেলা হয়েছে ভোগান্তিতে। বাহবা দেওয়ার বদলে এখন জীবন নিয়েই হুমকির মুখে পড়েছেন রাজধানীর ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি (DIIT)-এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী এই তরুণ উদ্ভাবক। এ নিয়ে ১৫ জুন রাজধানীর শাহবাগ থানায় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন তিনি। ডায়রি নম্বর ৭২৭। 

ডায়রি সূত্রে প্রকাশ, গত ১২ জুন বিকেলে অজ্ঞাত মেইল ঠিকানা থেকে তাকে অশ্রব্য ভাষায় গালাগালিসহ তাকে মেরে ফেলার হুমকী দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, অ্যাপটি যেন গুগল প্লে থেকে সরিয়ে ফেলে সে জন্যও দফায় দফায় ‍অপচেষ্টা করেছে। তার ডেভেলপার অ্যাকাউন্টটি সাময়িক স্থগিত করতে সক্ষম হলেও গুগল-এ তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ১১ জুন এটি ফেরত পেয়েছে মোঃ ইব্রাহিম মোল্লাহ। 

এরপর অ্যাপটি তিনি বাংলাদেশ সরকারকে উপহারস্বরূপ দিয়েছেন, কোনো ধরনের পারিশ্রমিক বা আর্থিক সুবিধা ছাড়াই। 

কী আছে ‘বাজারদর’ অ্যাপে?
‘বাজারদর’ অ্যাপের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্ব্বোচ্চ যৌক্তিক বিক্রয়মূল্য জনগণের হাতে পৌঁছে যাবে সরাসরি মোবাইল স্ক্রিনে।  রয়েছে অফলাইন ব্যবহারের সুবিধাও, যাতে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও পুরনো তথ্য দেখা যাবে।

শুধু তাই নয়, মাত্র ১০ এমবির ও কম সাইজের এই অ্যাপ ব্যবহার করা একেবারে সহজ, এটির ইন্টারফেস ইব্রাহিম এমনভাবে বানিয়েছেন, যেন যারা অ্যাপস ব্যবহারে অভ্যস্ত নন, তারাও যেন খুব সহজে অ্যাপটি ব্যবহার করতে পারেন।

কৃষকদের ক্ষমতায়ন ও সিন্ডিকেট বিরোধী কার্যকারিতা

এই অ্যাপের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর, যারা দীর্ঘদিন ধরে পাইকারি পর্যায়ের সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষক জানবেন শহরের বাজারে তাঁর উৎপাদিত পণ্যের দাম কত, এবং সেই অনুযায়ী দালালদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারবেন। ফলে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী অতিরিক্ত লাভ করতে পারবেন না। এছাড়া ভোক্তারাও সহজেই জানতে পারবেন পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য কত। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘চাঁদাবাজি’ ও দাম বাড়ানোর অসৎ চক্রগুলো চাপের মুখে পড়বে।

বাধা ও প্রাণনাশের হুমকি
এই যুগান্তকারী উদ্যোগের কারণে ইতোমধ্যে অস্বচ্ছ স্বার্থান্বেষী মহল সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, ১০ জুন ২০২৫ তারিখে গুগল প্লে স্টোরে ‘বাজারদর’ অ্যাপের অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, একটি প্রভাবশালী মহল প্রচুর অর্থ খরচ করে Google-কে বিভ্রান্ত করেছে, যাদের স্বার্থ এই অ্যাপের মাধ্যমে হুমকির মুখে পড়তে পারে। তবে উদ্ভাবক ইব্রাহিম মোল্লা দৃঢ় মনোবলে গুগলে আপিল করে ১১ জুন অ্যাকাউন্ট পুনরুদ্ধার করেন।

এই ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে অজ্ঞাত এক ইমেইল অ্যাকাউন্ট থেকে ১২ জুন ইব্রাহিম মোল্লাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তিনি শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন, এবং জানিয়েছেন যে তিনি ভয় পান না, বরং জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।

তরুণ উদ্ভাবকের হাতে নতুন সম্ভাবনা
‘বাজারদর’ অ্যাপ কেবল একটি মোবাইল অ্যাপ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনবে বলে মনে করেন তরুণ উদ্ভাবক মোঃ ইব্রাহিম মোল্লা। তার প্রত্যাশা, অ্যাপটির মাধ্যমে কৃষক, ভোক্তা ও নীতিনির্ধারকরা হাতে পাবেন তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ। একই সঙ্গে দেশজুড়ে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে একটি ন্যায্য ও টেকসই বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

ইব্রাহিমের সন্দেহ, ‘বাজারদর’ অ্যাপটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকারকে উপহার দেওয়ার ফলে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের বিরাগভাজন তিনি হয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে এধরনের প্রযুক্তি-নির্ভর প্রকল্প সাধারণত মোটা অংকের বাজেটের টেন্ডারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এই সুযোগে কিছু চক্র দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে সরকারী কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে, যারা বৈধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে এ ধরনের কাজ বাগিয়ে নেয়। ‘বাজারদর’ অ্যাপটি সরকারকে কোনো অর্থ ছাড়াই সরবরাহ করায় সেই চক্রের স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।