প্রযুক্তিখাতে কী থাকছে বাজেটে?

- ওটিটি-স্ট্রিমিংয়ে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক
- ইন্টারনেট সেবায় কমছে উৎসে কর
- অনলাইন সেলস কমিশন বাড়ছে,
- মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়লো ২ বছর
আগামী ২ জুন, সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার প্রায় সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত। বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। বিপরীতে অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
ওটিটি’র ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বিষয়ে আইএসপিএবি জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক মনে করেন, দেশীয় ওটিটি বিকাশে এটা একটা বড় বাধা হিসাবে কাজ করবে। একইভাবে ইন্টারনেট সেবার ওপর উৎসে কর উঠিয়ে নেয়ার দাবি করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “যেহেতু, এখন গ্রাহক পর্যায়ে আইএসপিরা ব্যান্ডউইথ দ্বিগুণ করেছে, সেহেতু এটা শন্য শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। আর বিদেশি ওটিটি যেমন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি প্লাস, হুলু, হইচই। সেখানে তারা ১০% সম্পূরক শুল্ক বসাতে পারে সরকার। কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তা এবং কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত যে কোন ওটিটি তে অবশ্যই ০% শুল্ক হওয়া উচিত। সেই সাথে ওটিটিকে ই ক্যাবের মেম্বারশিপ বাধ্যতামূল থাকা উচিত।”
ওদিকে মোবাইল ফোনসেট উৎপাদন ও সংযোজনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে মোবাইল ফোন উৎপাদনে বর্তমানে ২, ৫ ও ৭.৫ শতাংশ যে তিনটি ভ্যাট হার আছে, তা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪, ৭.৫ ও ১০ শতাংশ করা হতে পারে। অবশ্য এই হার দুই বছরের জন্যই প্রযোজ্য হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাওমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বললেন, আমি মনে করি ভোক্তা পর্যায়ে এর কোন প্রভাব পড়বে না। উৎপাদন পর্যায়ে মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারকদের লাভের পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে, তবে সেটাও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেশিরভাগ মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক প্রায় ৩০% মূল্য সংযোজন করে, এবং ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে এত বেশি ব্যয় হয় না। তাই আমার ধারণা, ব্যবসায়িক পর্যায়েও এর কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না।
ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে লিফট উৎপাদন, এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদন, মোটরকার-মোটর ভেহিক্যাল ও ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল এবং আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে। এ ছাড়া রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনারের কম্প্রেসারে কাঁচামাল আমদানির সম্পূরক শুল্কে অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। তবে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন করে ভ্যাটের হার বাড়ছে। ৩০ ইঞ্চি কম্পিউটার মনিটর উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। তবে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন এবং এলপিজি সিলিন্ডার নির্মাতাদের জন্য ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।
হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের জন্য আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে আসন্ন বাজেটে। ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হতে পারে বলে জানাগেছে। এতে এই খাতে খুব সামান্য প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন স্মার্ট টেকনোলজিস (বা) লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম।
অপরদিকে বিভিন্ন সফটওয়্যার আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। হার্ডওয়্যারের নির্মাতাদের ওপর বিদেশি সফটওয়্যারের সঙ্গে দেশি সফটওয়্যারের অসম প্রতিযোগিতা হবে।
এ বিষয়ে বেসিস সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বললেন, যে যে ধরণের সফটওয়ার দেশেই তৈরি হয়, সেগুলোর উপর শুল্ক না কমানোই ভালো। তবে, আমি মনে করি যেসকল প্রতিষ্ঠান তাদের মোট সফটওয়ার ক্রয়ের নূন্যতম ৫০% দেশীয় সফটওয়ারে ব্যয় করে, তাদের টাক্স রিবেট বা অন্য কোন প্রণোদনা দেয়া হোক। এতে দেশীয় সফটওয়ার কিনতে উৎসাহ বাড়বে।
আর হার্ডওয়্যার খাত নিয়ে তার মত, এতে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত হার্ডওয়ার পণ্যের সাথে পাল্লা দেয়া কঠিন হবে এবং দেশীয় হার্ডওয়ার শিল্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের জন্য ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত হার্ডওয়ার পণ্যের সাথে পাল্লা দেয়া কঠিন হবে এবং দেশীয় হার্ডওয়ার শিল্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। আমার মতে, দেশে সংযোজিত হার্ডওয়ার শিল্পকে এগিয়ে নিতে এর উপর থেকে ভ্যাট মওকুফ করা উচিত।
এদিকে অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে কমিশনের ওপর ভ্যাট তিনগুণ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে আসছে বাজেটে। এর প্রভাব পড়বে সরাসরি বড় ই-কমার্স প্লাটফর্ম তথা মার্কেট প্লেসগুলোর ওপর। কিন্তু যারা নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করেছে, অনলাইন সেলস কমিশনের ভ্যাট বৃদ্ধি তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না।
এ নিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিল-এর প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও বেসিস সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেছেন, “অনলাইন সেলস কমিশনের ওপর এই ভ্যাট বৃদ্ধি সরাসরি প্রভাব ফেলবে বড় বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর। যেমন দারাজ, পাঠাও কিংবা ফুডপান্ডার মতো কমিশনভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহ। মূলত যাদের বিজনেসের রেভিনিউ মডেল সেলস কমিশনের উপর নির্ভরশীল তাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাবটা সরাসরি পড়বে এবং তাদের ব্যবসায়িক খরচ বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে এই খরচ তারা আসলে ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করবে। অর্থাৎ, ভ্যাট বৃদ্ধির হার যদি চূড়ান্ত বাজেটে বলবৎ থাকে তাহলে পরোক্ষভাবে এটা ক্রেতাদের ওপরই বর্তাবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ই-কমার্স শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলা যেতে পারে।“
ঢাকা শহরের অন্যতম বিরক্তিকর পরিবহন ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই রিকশার ১২০০ ওয়াটের ডিসি মোটরের কাস্টমস শুল্ক ১ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। একইভাবে উড়োজাহাজের কাস্টমস শুল্ক শূন্য থেকে ১ শতাংশ এবং হেলিকপ্টারে মোট করভার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এলইডি বাতির ওপর বাতি তৈরির উপকরণে বসানো হয়েছে ১০ শতাংশ বাড়তি কাস্টমস শুল্ক। এতে এই পণ্যটির দাম বাড়বে।
তবে বাজেট পাশ হওয়ার আগে নিশ্চিত বলা যাবে না এই বাজেট কতটা নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জন্য। আদৌ জীবনযাপনে আলো ফেলতে পারবে কি না। নাকি নতুন কোনো অন্ধকার মোকাবেলা করতে হবে তাদের।