নতুন হুমকী ই-সিগারেট

৩১ মে, ২০২৫  
৩১ মে, ২০২৫  
নতুন হুমকী ই-সিগারেট

‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে  শনিবার (৩১ মে)  উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও তামাক প্রতিরোধে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।  বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলিত। 

এসব উদ্যোগের পরেও নানা রূপে আর কৌশলে থেমে নেই এই নেশার বাজার। সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে তাই দিন দিন বাড়ছে ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম’ (এন্ডস) বা ‘ইলেকট্রনিক সিগারেট’ এর ব্যবহার। বিভিন্ন ফ্লেভার আর টেকি ফ্যাশনে ই-বর্জের নতুন অনুষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত হয়েছে এই ক্ষতিকর প্রযুক্তিটি। সিগারেটের মতই দেখতে ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত যন্ত্রগুলি আমদানি নিষিদ্ধ হলেও এগুলো বিক্রি ও ব্যবহার চলছে প্রকাশ্যেই। 

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে ই-সিগারেট ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রচলিত তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করেছে। একইসঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) অনুযায়ী শক্তিশালীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট, ফেসবুক পেজে নানা লোভনীয় বিজ্ঞাপন ও অফারে এগুলো বিক্রি হচ্ছে আইন ভেঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের ভেপগুলো দামি সিগারেট থেতে সাশ্রয়ীও হচ্ছে। উপরন্তু প্রযুক্তির আকর্ষণে অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণরা এগুলো সংগ্রহক করছেন খুব সহজেই। ফলশ্রুতিতে হাসপাতাল, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্রই চলছে ভেপিংয়ের মহোৎসব। এর ফলে ধূমপায়ী ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছে অধূমপায়ীরাও। বিশেষ করে নারী ও শিশুরাও ক্যানসার, হার্ট ও কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী ধূমপায়ীদের সংখ্যাও।

বিভিন্ন জরিপ বলছে, দেশের ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২ কোটি ২০ লাখ (২০ দশমিক ৬ শতাংশ) এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ (১৮ শতাংশ)। পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। তামাক ব্যবহারে পঙ্গুত্ব বরণ করছে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭ সালের তথ্যমতে, দেশে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান ও তামাক সেবন করে। এর সঙ্গে আরও একটা অংশ রয়েছে, যারা এ গণনার বাইরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এ বদভ্যাস রয়েছে, যা একটি অশনিসংকেত।  

অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের একটি জরিপে শতভাগ বাসেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৯১ শতাংশ পাবলিক বাসে সরাসরি ধূমপান করা হয়। ধূমপান করতে দেখা যায়নি মাত্র ৯ শতাংশ বাসে। ৭৯ শতাংশ বাসে উঠতে বা নামতে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ বা বাট দেখা গেছে। জরিপে ৪১৭টি বাস পরিদর্শন করে কোনোটিতেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৯৯ শতাংশ বাসে কোনো নোটিশই পাওয়া যায়নি। এছাড়াও গণপরিবহনগুলোতে শতকরা ৮৯ শতাংশ ধূমপান করেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের ৬২ শতাংশ গণপরিবহনে দায়িত্ব পালনের সময়েও ধূমপান করেন।

ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, সিগারেটের চেয়েও মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকি তৈরি করতে পারে এসব ভেপিং টুল। তারা বলেছেন, ই-সিগারেটের কারণে মানুষ ভেপের মধ্যে নিকোটিন ভরে তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেন। আর এ ধরনের ভেপ সাধারণত প্রোপিলিন গ্লাইকল, গ্লিসারিন, ফ্লেভারিং ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থওয়ালা তরল গরম করে তৈরি হয়।

ভেপিংয়ের মাধ্যমে এসব উচ্চমাত্রার নিকোটিন হার্টরেট ও রক্তচাপ বাড়ানোর পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন রক্তনালীকে সংকুচিত ও ধমনীর প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ অভ্যাস ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘যারা ভেপ গ্রহণ করছেন তাদের বিপদ ধূমপায়ীদের থেকে একেবারেই আলাদা নয়’। কার্ডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন বা হৃদরোগ পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ ও এ গবেষণার প্রধান গবেষক ড. ম্যাক্সিম বোইডিন বলেছেন, ‘ধূমপায়ীদের মধ্যে বাইরে গিয়ে ধূমপান করার প্রবণতা থাকে এবং একবার একটি সিগারেট শেষ হয়ে গেলে তাদের চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকটি সিগারেট জ্বালাতে হয়। তবে ভেপের ক্ষেত্রে আপনি চাইলেই এটির গ্রহণ চালিয়ে যেতে পারেন। এজন্য কতোগুলো পাফ টেনেছেন তা খেয়াল রাখা সম্ভব হয় না।’ তাই না থেমে বা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ভেপ নেওয়ার কাজটি অনেক সহজ। কারণ এমনসব জায়গাতেও আপনি এটি গ্রহণ করতে পারেন, যেখানে ধূমপানের সুযোগ কম।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ভেপিংয়ের বিভিন্ন বিপদ ধূমপায়ীদের চেয়ে আলাদা নয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএসের) প্রধানরা ভেপিংকে ধূমপানের চেয়ে নিরাপদ বলে দাবি করলেও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ভেপিং ঝুঁকিমুক্ত নয় একেবারেই। তারা বলছেন, ই সিগারেট বা ভেপে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ থাকে, যেগুলোর দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন প্রভাব এখনও রহস্য হিসাবেই রয়ে গেছে।

চিকিৎসকরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, অল্প বয়সী যারা এ অভ্যাস গ্রহণ করেছেন আগামী দশকে তাদের মধ্যে ফুসফুসের রোগ, দাঁতের সমস্যা ও ক্যান্সারের মতো রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। এ গবেষণায় গড়ে ২৭ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের ওপর নজর দেন গবেষকরা, যাদের প্রত্যেকেরই শারীরিক ফিটনেসের অবস্থা একইরকম। তাদের দেহের বিভিন্ন রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা ও মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের গতি পরিমাপ করতে নিয়মিত স্ট্রেস টেস্ট পরীক্ষা করেছেন তারা।

এসব পরীক্ষার ১২ ঘণ্টা আগে কেবল পানি পান করেছে তারা। এ সময় ভেপ, ধূমপান ও ব্যায়াম থেকে দূরে ছিলেন অংশগ্রহণকারীরা।

এতো ক্ষতির মধ্যেও সম্প্রতি থেমে নেই ই-সিগরেটের প্রসার। রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্স থেকে পৃথক তিনটি চালানে আট কোটি টাকার শর্ত সাপেক্ষে আমদানিযোগ্য বিদেশি সিগারেট ও আমদানি নিষিদ্ধ ভেপ ফ্লেভার সমৃদ্ধ ই-সিগারেট জব্দ করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউজ। এসব চালানে প্রায় ৩০০ লিটার ডেপ ফ্লেভার সমৃদ্ধ ১২ হাজার ৯৮০টি ই-সিগারেট আনা হয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ‘কনজাম্পশন পণ্য’ এবং ‘লিথিয়াম ব্যাটারি’ ঘোষণা দিয়ে শর্তসাপেক্ষে এই নিষিদ্ধ ই-সিগারেট আমদানি করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আইজিএম। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যমান তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। যা তামাকের ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারছে না। তাই এই মৃত্যুর মিছিল কমাতে দ্রুত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। তার মনে করেন, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে হলে নীতিমালায় কঠোরতা আনতে হবে, বাড়াতে হবে জনসচেতনতা। তরুণ সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে এই আন্দোলন শুধু একটি দিবস নয়, এটি হতে হবে প্রতিদিনের প্রতিজ্ঞা।