বাংলাদেশকে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে চীন: গবেষণা প্রতিবেদন

১১ মার্চ, ২০২৫  
১১ মার্চ, ২০২৫  
বাংলাদেশকে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে চীন: গবেষণা প্রতিবেদন

বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে চীন। এর মাধ্যমে দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটি (ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেস) গড়ে তোলার প্রচেষ্ট নিয়েছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার (১১ মার্চ) প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ইমেজ অব চায়না ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য জানানো হয়। স্থানীয় একটি হোটেলে সেন্টার ফর অলটারনেটিভ আয়োজিত গবেষণাপত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর এবং সেন্টার ফর অলটারনেটিভের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ প্রমুখ এতে অংশগ্রহণ করেন।

‘ন্যাশনাল ইমেজ অফ চায়না ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে সেমিনারের আয়োজন করে সেন্টার ফর অল্টারনেটিভ। শুরুতেই একটি জরিপ উপস্থাপনা করেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। গত ৩ বছরে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়।

এ সময় ফরেন সার্ভিস একাডেমির সাবেক রেক্টর মাশফি বিনতে শামস জানান, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের সহায়তা চান তিনি।

মাশফি বিনতে শামস বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। সবার ধারণা, মিয়ানমারের ওপর চীনের বেশ প্রভাব রয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে চীন। এক্ষেত্রে তারা সহযোগিতা করবে বলে আশা করি।’

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। আইসিজি, আইসিসি-সব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। এখন সময় এসেছে নতুন বিকল্প নিয়ে ভাবার। অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমার মনে হয়, এখন সেই সময় যখন আমরা একটি মার্শাল প্ল্যান বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করতে পারি।’

চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট ও সর্বজনীন কোনো রূপ নেই। প্রতিটি দেশ গণতন্ত্রের নিজস্ব ধারা চর্চা করে। কথা বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও।

ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘যে সরকার গঠন করবে চীন তার পার্টনার হবে। কোন নির্দিষ্ট সরকার বা পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আমাদের নীতি নয়। আমাদের সম্পর্ক বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে। আমরা মনে করি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকার একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে পারবে। এক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

আলোচকেরা বলেন, শুধু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নয়, চীনের সভ্যতার আধুনিকতাকেও অনুধাবন করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের আগে বাংলাদেশ ও চীনের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। সবকিছুঠিক থাকলে আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাবেন প্রধান উপদেষ্ট। ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, বেইজিং বাংলাদেশকে রাইফেল, রকেট লঞ্চার, ম্যানপ্যাড, হালকা ইউটিলিটি যানবাহন ইত্যাদির মতো ছোট ও মাঝারি আকারের অস্ত্রের জন্য বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি এবং বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে প্রযুক্তি স্থানান্তর করেছে, যা একটি দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটি (ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেস) গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা। ২০১২ সালে চীনা সহায়তায়, বাংলাদেশ নৌবাহিনী খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত প্রথম দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পেট্রোল জাহাজও নৌবহরে অন্তর্ভুক্ত করে।

২০২৪ সালে আগস্টে ক্ষমতা পালাবদলের পরও দুই দেশের সম্পর্কে কোনও ধরনের পরিবর্তন হয়নি বলে জানানো হয় গবেষণা প্রতিবেদনে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি তাদের যুদ্ধজাহাজ চি জিগুয়াং এবং জিং গ্যাংশানকে চট্টগ্রাম বন্দরে শুভেচ্ছা সফরের জন্য পাঠিয়েছিল।

অনুষ্ঠানে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়— এটি ঢাকায় ক্ষমতার পরিবর্তন সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকার প্রতীক। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি ছিল কোনও বিদেশি নৌযানের প্রথম সফর। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও দৃঢ় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের ইচ্ছার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আরও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চায় এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে।

সামরিক চুক্তি

২০০২ সালে উভয় দেশ সামরিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরক্ষা উৎপাদনসহ একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরফলে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে পৌঁছায়। এই চুক্তিটি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে খণ্ডিত পদ্ধতি গ্রহণের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সহায়তা করেছিল। উল্লেখ্য, চীন হলো দুটি দেশের মধ্যে প্রথমম, যারা বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে।

২০১৪ সালে উভয় দেশ সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে চারটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, এর মধ্যে একটি চুক্তি ছিল— যেখানে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে (এএফবি) বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহসহ সামরিক সহায়তা প্রদান করবে। আরেকটি চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে, পিএলএ বাংলাদেশকে ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)’ একটি ভাষা ল্যাব স্থাপনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ এবং চীন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানেও (ইউএনপিকেওএস) সহযোগিতা করে। ২০২৪ সালের মে মাসে উভয় দেশ একটি ঐতিহাসিক যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজন করে, যা তাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পুনর্ব্যক্ত করে।

প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয়

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর থেকে এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে, সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রতিরক্ষা সহায়তার জন্য চীন একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে ওঠে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ১৯৭৫ সাল থেকে ঢাকা ভারত-সোভিয়েত অক্ষ থেকে পাকিস্তান-চীন অক্ষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। সোভিয়েত সামরিক সহযোগিতা কমে যায় এবং চীন শূন্যস্থান পূরণের সুযোগ নেয়। বাংলাদেশের কৌশলগত বিবেচনার কারণে চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও গতিশীল হয়ে ওঠে। কারণ বড় একটি সময়জুড়ে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে প্রতিকূল পরিবেশ বজায় রেখেছিল।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চীনের প্রতিরক্ষা সহায়তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, কারণ এটি ওই সময়ে বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করে।

গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ চীনা অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনের মোট অস্ত্র বিক্রির ১১ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত চীন থেকে তার মোট অস্ত্রের প্রায় ৭২ শতাংশ অস্ত্র কিনেছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুসারে, ২০১০-২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন থেকে অস্ত্র ক্রয়ে ২৫৯ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। ঢাকা বেইজিং থেকে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র কিনেছে, যার মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক টহল জাহাজ, কর্ভেট, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান এবং ভূমি থেকে আকাশ এবং জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভিটি-৫ হালকা ট্যাঙ্ক এবং এমবিটি-২০০০ প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্কের মতো আধুনিক এবং অত্যাধুনিক চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কে-৮ এর মতো অত্যাধুনিক প্রশিক্ষক চীনা জেট ফাইটার এবং এফএম-৯০এর মতো স্বল্প-পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সারফেস এয়ার মিসাইল সিস্টেম চালু করেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২০৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একজোড়া চীনা মিং ক্লাস সাবমেরিন এবং সারফেস জাহাজ বহরের জন্য একটি নতুন প্রজন্মের চীনা টাইপ ০৫৬ স্টিলথ কর্ভেট কিনেছে।

শর্তহীন বিক্রি

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন যে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশে কোনও শর্ত যুক্ত করে না। এটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামের সুবিধা প্রদান করে, বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশ এই সুবিধা দেবে না।

চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক আধুনিকীকরণ অভিযান— ‘ফোর্স গোল ২০৩০’ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং চীনকে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে পরিণত করেছে। পূর্ব পরিচিতি, ঐতিহ্য এবং পছন্দের কারণে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তাদের অস্ত্রাগারে আধুনিক চীনা অস্ত্র সংগ্রহ করতে চায়। তাছাড়া, বেইজিং অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম খরচে আধুনিক, উচ্চ প্রযুক্তির এবং অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।

উভয় দেশ শান্তিরক্ষা, উন্নয়ন এবং সংঘাত নিরসনে সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং গঠনমূলক মনোভাব প্রদর্শন করেছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রথম দিক থেকেই, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় এবং সরবরাহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে, সময়ের সাথে সাথে, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কেবল অস্ত্র বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সামগ্রিক হয়ে উঠেছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।