এআই পুলিশিং শঙ্কায় ৭ বিষয়ে সতর্ক ইইউ

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  
এআই পুলিশিং শঙ্কায় ৭ বিষয়ে সতর্ক ইইউ

জুলাই বিপ্লবের ঘটনায় দেশজুড়েই আস্থার তলানিতে বাংলাদেশ পুলিশ। বিশ্বের অনেক দেশেই আইনশঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত নিয়মিত বাহিনীর কাজ নিয়ে আস্থার সঙ্কট দেখা যায়। এই সঙ্কটের কথা চিন্তা করে এরই মধ্যে পুলিশের কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তবে সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা। ফলে গত ২ ফেব্রুয়ারি এআই আইনে প্রযুক্তির কিছু “অগ্রহণযোগ্য” ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এআই ব্যবহারে বাধ সাধা হয়েছে ৭টি ক্ষেত্রে।

যদিও ইতিমধ্যেই অপরাধীদের দ্রুত পাকড়াও করতে ফেসিয়াল রিকোগনিশন, অপরাধ ঘটার আগেই তা ঠেকিয়ে দিতে বিপুল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। ফলে মাঠে ফুটবল ম্যাচের মতো বিস্তৃত এলাকায় স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধ ঘটার আগেই সতর্ক হওয়া যায় বলে জানা যাচ্ছে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, পুলিশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার পক্ষপাতমূলক হয়ে উঠতে পারে। এই প্রযুক্তিটি ব্যক্তির রঙ, লিঙ্গভেদ নাও সনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশী নজরদারিতে থাকা সংখ্যালুঘু এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি মনে হতে পারে।

এমন বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুগান্তকারী এআই আইনের অধীনে প্রথম সেটে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা করা হয়েছে। আইনের অধীনে ‘অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি’ হিসাবে বিবেচিত এআই সিস্টেম ব্লক করা হয়েছে। “মানুষের নিরাপত্তা, জীবিকা এবং অধিকারের জন্য স্পষ্ট হুমকি” বলে বিবেচিত হওয়ায় সামাজিক স্কোরিং সিস্টেম, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেগ বুঝতে পারে এমন এআই সিস্টেম; ব্যক্তিগত ফৌজদারি অপরাধ ঝুঁকি মূল্যায়ন বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে এমন টুলস, ক্ষতিকারক এআই কারসাজি এবং প্রতারণা এবং দুর্বলতা কাজে লাগানোর জন্য ক্ষতিকারক এআই টুলস ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এরমাধ্যমে মুখ শনাক্তকরণ ডাটাবেস তৈরি বা সম্প্রসারণের জন্য ইন্টারনেট বা সিসিটিভির লক্ষ্যবস্তুহীন স্ক্র্যাপিং; নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের জন্য বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ; এবং জনসাধারণের অবাধ চলাচলের স্থানে আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যে রিয়েল-টাইম রিমোট বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণের মতো এআই নির্ভর টুলস ব্যবহারেও বাধ সাধা হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পূর্বসূরী রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের এআই সুরক্ষা সম্পর্কিত একটি নির্বাহী আদেশ ছিঁড়ে ফেলে এই বিপরীত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ নিয়ে ইতালীয় আইন প্রণেতা ব্র্যান্ডো বেনিফেই বলেছেন, “সামাজিক নিয়ন্ত্রণ” বা “আমাদের স্বাধীনতার সংকোচনের” জন্য এআই এর ব্যবহার এড়ানো এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য। এটি উদ্বেগের একটি ক্ষেত্রের উপর খুব বেশি কেন্দ্রীভূত, যা আমাদের গণতন্ত্রের সুরক্ষার সাথে যুক্ত। তবে এটি বাস্তবায়ন একটু অগোছালো হতে পারে। ইউরোপীয় পুলিশ এবং অভিবাসন কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানে রিয়েল-টাইম ফেসিয়াল রিকগনিশনের মতো বেশ কয়েকটি এআই ব্যবহার করছে। এটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে দীর্ঘ ছাড় রয়েছে সেই তালিকা এবার কিছুটা হলেও সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছে।

তবে শিক্ষাবিদ এবং অ্যাক্টিভিস্টরা আইনটি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কেইউ লিউভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই নীতিশাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষক নাথালি স্মুহা’র মতে, আইনে এতো ব্যতিক্রম থাকলে আপনি কি সত্যিই নিষেধাজ্ঞার কথা বলতে পারেন কি না এখানে সেই প্রশ্ন আপনি তুলতে পারেন। কেননা, ২০১৮ সালে যখন ইউরোপীয় কমিশন তার বিশেষজ্ঞদের একটি এআই কৌশল তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল, তখন কিছু এআই ব্যবহারের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবা হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞ এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা দ্রুত তাদের মতামত পরিবর্তন করেন। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ দলের কাজের সমন্বয়কারী স্মুহা বলেন, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদ্যমান আইন কিছু নির্দিষ্ট কাজ ঠেকাতে ব্যর্থ হতে পারে।

২০২১ সালের এপ্রিলে কমিশনের নতুন এআই নিয়মের প্রথম খসড়ায় ইতিমধ্যেই বেশ কিছু অনুশীলন নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই যেমন “একজন ব্যক্তির আচরণ বিকৃত করে” অধস্তন কৌশলের মাধ্যমে বা দুর্বল গোষ্ঠীগুলিকে শোষণ করতে পারে এমন বিষয়টিকে গুরুত্বারেপা করা হয়। বিলটি আলোচনার জন্য ইউরোপীয় সংসদে গেলে, আইন প্রণেতারা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করার সময় সেই তালিকায় আরও বেশি কিছু বিষয় যোগ করেন। এরপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সম্মতি নিয়ে আইনের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়েছিল।

এ নিয়ে এআই আইন আলোচনায় সংশ্লিষ্ট ডাচ গ্রিনস আইন প্রণেতা কিম ভ্যান স্পারেন্টাক বলেন, তালিকার নিষেধাজ্ঞাগুলি তিনটি বিভাগে বিভক্ত। এমন কিছু জিনিস আমরা জানতাম যা আমরা চাই না, [এবং] এমন কিছু জিনিস যা আমরা কিছুটা হলিউডের সিনেমা থেকে অথবা চীন থেকে কল্পনা করতে পারি।

খসড়া তৈরিতে প্রভাব ফেলেছিল এমন একটি ঘটনা যা ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসে শিশু যত্ন সুবিধা জালিয়াতি সনাক্ত করার জন্য ডাচ কর কর্তৃপক্ষের একটি অ্যালগরিদম ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে প্রায় ২৬,০০০ লোককে ভুলভাবে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এই ধরণের অনুশীলন এখন নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশিংয়ের আওতায় পড়ে।

“যদি আপনি এমন একটি সমাজ চান যা আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে তৈরি, তাহলে আপনি মানুষের সাথে ক্রমাগত এমন আচরণ করতে পারবেন না যেন মনে হয় তারা ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য অপরাধী,” – যোগ করেন ভ্যান স্পারেন্টাক। একইভাবে, ইন্টারনেট থেকে মানুষের মুখের ছবি স্ক্র্যাপ করার উপর নিষেধাজ্ঞা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ক্লিয়ারভিউ এআই থেকে এসেছে, যা একটি ফেসিয়াল রিকগনিশন ফার্ম যা কোটি কোটি ছবি তাদের ডাটাবেসে টেনে আনার জন্য তদন্ত করেছে। এআই আইন “ইন্টারনেট থেকে মুখের ছবি বেশুমার স্ক্র্যাপ করার মাধ্যমে ফেসিয়াল রিকগনিশন ডেটাবেস তৈরি বা সম্প্রসারণকারী এআই সিস্টেম” ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। চীন হয়তো আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার অনুপ্রেরণা দিয়েছে, যেমন সামাজিক স্কোরিং নিষিদ্ধকরণ ( এটি আচরণের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিদের র‍্যাঙ্কিং করার চীনা ব্যবস্থা)।

গেলো জানুয়ারিতে একটি খোলা চিঠিতে ডিজিটাল অধিকার প্রচারকরা এআই আইনের বিশেষ করে পুলিশিং এবং মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে “বিভিন্ন গুরুতর ফাঁক” আছে বলে উল্লেখ করেছেন। ডিজিটাল অধিকার গ্রুপ অ্যাক্সেস নাউ-এর ইইউ নীতি বিশ্লেষক ক্যাটেরিনা রোডেলি বলেছেন “সবচেয়ে স্পষ্ট ফাঁক হল এই যে নিষেধাজ্ঞা এগুলো আইন প্রয়োগকারী এবং মাইগ্রেশন কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়”।

সবার জন্য উন্মুক্ত স্থানে রিয়েল-টাইম ফেসিয়াল রিকগনিশনের উপর নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় ছাড়।নীতিগতভাবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি আর এটি করতে পারবে না, তবে ইইউ দেশগুলি এখনও ব্যতিক্রমগুলি অনুমোদন করতে পারে, বিশেষ করে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে। আইনে স্কুল বা অফিসে আবেগ শনাক্ত করার জন্যও এআই ব্যবহার করা যাবে না, তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কেননা সীমান্তে মিথ্যা সনাক্তকারী এআই যন্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে, যা প্রতারণার কোনও চিহ্নের জন্য মুখ স্ক্যান করে।

ভ্যান স্পারেন্টাক বলেছেন, এই ধরণের ছাড় ইইউ সরকারগুলির জন্য আলোচনার সময় একটি লাল রেখা ছিল, যার ফলে শেষ-খুঁজির আলোচনা ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে বাধ্য হয়েছিল। আসলে তারা তাদের হাতে থাকা সমস্ত টুল ব্যবহারে সক্ষম হতে চায়।

সিএনবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, যেসব কোম্পানি এআই আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হবে তাদের প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ইউরো (৩৫.৮ মিলিয়ন ডলার) অথবা তাদের বিশ্বব্যাপী বার্ষিক আয়ের ৭ শতাংশ (যে পরিমাণ বেশি) জরিমানা করা হতে পারে। গত বছরের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে এআই-এর জন্য এ ধরণের প্রথম নিয়ন্ত্রক কাঠামো চালু করা হয়েছিল। তবে, আইনের একাধিক বিধান পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারী ওয়েবসাইট অনুসারে, সাধারণ-উদ্দেশ্যমূলক এআই মডেল তৈরিকারী প্রযুক্তি সংস্থাগুলির জন্য প্রশাসনিক নিয়ম এবং বাধ্যবাধকতাগুলি ২রা আগস্ট, ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। সাধারণ-উদ্দেশ্যে যেসব কোম্পানি শিক্ষা, চিকিৎসা এবং পরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ AI সিস্টেম তৈরি করে, তাদের ২ আগস্ট, ২০২৭পর্যন্ত বর্ধিত সময় রয়েছে।