টেলিকম গ্রাহক সেবার পথে বড় বাধা আস্থার সংকট

১২ জুলাই, ২০২৫  
১২ জুলাই, ২০২৫  
টেলিকম গ্রাহক সেবার পথে বড় বাধা আস্থার সংকট

নতুন টেলিকম নীতিমালায় গ্রাহকের স্বার্থ সবার আগে বিবচনা করা উচিত বলে একমত সবাই। তবে তার আগে দূর করতে হবে স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে আস্থার সংকট। কমাতে হবে বিনিয়োগ ঘাটতি।

টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ- টিআরএনবি আয়োজিত  ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতি সংস্কার’ বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিব্যক্তি খাত সংশ্লিষ্টদের।

নীতিমালা সংস্কারের আগে বহুপক্ষীয় মতামত প্রকাশের নিয়মিত কর্মশালা ও বৈঠকের ধারাবাহিকতায়  ১২ জুলাই, শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে হোটেল হলিডে ইন এর সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই গোলটেবিল আলোচনা সভা।

টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে’র সভাপতিত্বে গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ জুলফিকার। 

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আছেন  প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বিষয়ক বিশেষ সহকারী  ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। 

আলোচক হিসেবে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মোঃ জহিরুল ইসলাম এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী।

টেলিকম খাত থেকে ব্যবসায় প্রতিনিধি হিসেবে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে অংশ নিয়েছেন গ্রামীণফোন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান, রবির মাদার কোম্পানি আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ এর এভিপি মোহাম্মাদ দিদারুল আলম, বাংলালিংক এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইওহান বুসে এবং টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ।

গোলটেবিল সভায় উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব এর মহাসচিব মোহাম্মাদ জুলফিকার জানান, ডিজিটাল অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে টেলিকম অপারেটর। সাড়ে ৬ কোটি সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযুক্ত। তারপরও দেশের ৯ কোটির মতো মানুষ এখনো নেটওয়ার্কে সংযুক্ত নন। তারা কোনো ডিজিটাল সেবা পাচ্ছেন না। প্রতিবছরই বাড়ছে পরিচালনা ব্যয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত টেলিকম নীতিমালায় বিদেশী বিনিয়োগে শতাংশ বেধে স্থানীয় পর্যায় ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ ও লক্ষ্য পূরণে সময় বেধে দেয়া রীতিমত ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

নীতিমালার বাকি অংশকে স্বাগত জানানিয়ে তিনি বলেন,  নতুন লাইসেন্সিং কাঠামো প্রযুক্তি-নিরপেক্ষ করার পাশাপাশি নীতিমালায় লাইসেন্স তিনটিতে নামিয়ে আনা হচ্ছে। একই লাইসেন্সের আওতায় একাধিক ধরনের সেবা দিতে পারবেন অপারেটররা। ভয়েস, ডেটা (ইন্টারনেট), ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভ্যাস) ও ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) সার্ভিস দেওয়ার সুযোগ থাকছে নতুন লাইসেন্স নীতিমালায়। এটা এই খাতের বিকাশে সহায়তা করবে। তবে শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ না রাখায় উন্নয়নের গতি স্লোথ হবে। 

এর পরিপ্রক্ষিতে বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে দেশী মালিকানায় গুরুত্ব দিয়ে ফাইবার অ্যাট হোম সিআইও সুমন আহমেদ সাবির বলেন, আরো কিছু বিষয়ে লক্ষমাত্রা বেধে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। গত সাত বছরে এই খাতে কত টাকা বিনিময়োগ হয়েছে তা হিসাব করা দরকার। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ খরচ সাশ্রয়ী পথ বেছে নিতে হবে। লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ১২ হাত বহরে ১৩ হাত কাপড় নীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এসময় আর বেশি এনটিটিএন লাইসেন্স না দেয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। 

তিনি বলেন, ব্যবসায় পরিবেশ সমন্বিত রাখতে হলে অতিরিক্ত লাইসেন্স ক্ষতিকর। আবার একই কাজ জনে জনে না অবকাঠামোর সমন্বিত উন্নয়ন ও ব্যবহারের কথা ভেবে দেখা উচিত।  

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির বলেন, আমি মনে করি, বিনিয়োগের ক্ষত্রে কনসিস্টিন্সি, ক্যাপাসিটি, কোলাবরেশন ও কো অর্ডিনেশন দরকার। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ থাকা দরকার। প্রতি বছর মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্ক চালু রাখতে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তাই দেশে টেলিকম রোড ম্যাপ দরকার।

বিশ্বব্যাংক পরামর্শক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পলিসি সঠিক পথেই আছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে পিওর ডিজায়ার নাই। মুক্তবাজার হিসেবে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো সীমা রেখা থাকা উচিত না। বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সব দেশেই থাকে। এমভিএনও নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। 

তিনি আরো বলেন,  বিদেশি ইনভেস্টররা যখন ৭৫ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার থাকেন তখনই তারা ওই কোম্পানির পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হন। ফলে তারা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোম্পানির স্বার্থে। এ ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারের তেমন কিছু করার থাকে না। সুতরাং সেদিক থেকে বিদেশি বিনিয়োগ আসা নিয়ে আমি তেমন কোনো সমস্যা দেখি না। এ ছাড়া গ্রামীণফোন ও রবির কিছুটা শেয়ার ইতোমধ্যেই দেশীয় প্রতিনিধির কাছে আছে। নেই শুধু বাংলালিংকের। আমার মনে হয়, যদি এই শেয়ার ছাড়ার সময় কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তা হলে এটা তেমন কোনো সমস্যা নয় বরং দেশীয় ইনভেস্টরদের জন্য ভালো। তারাও এই খাতে যুক্ত হতে পারলেন।  

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, দশের মানুষের মোট চাহিদা ৭.৫ টেরাবাইট। এর ৬৫-৭০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায় আইএসপিরা। এজন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের ৩৫ শতাংশ বাজার শেয়ার থাকলেও তাদের কর দিতে হচ্ছে না। এই বৈষম্য দূর করা দরকার। পলিসিতে লেভেল প্লে‌ইং ফিল্ড তৈরি করা দরকার।

তিনি আরো বলেন, দেশে বর্তমানে মানুষের মোট চাহিদা ৭ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৮ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ। এই চাহিদার ৬৫-৭০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায় আইএসপিরা। সেই আইএসপির জন্য দাম ফিক্সড করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের জন্য এটা ওপেন মার্কেট। এটা একটা বিরাট বৈষম্য, বিশেষ করে বর্তমান এই সরকারের কাছে। অ্যাক্টিভ শেয়ারিংটা মনে হয় শিগগিরই অনুমোদন দেওয়া উচিত। এটা লাস্ট মাইল ইউজারের স্বার্থেই আমাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করা উচিত।

আলোচনায় আারো বক্তব্য রাখেন গ্রামীণফোনের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মাদ, বাংলালিংক চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান এবং রবির চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার শাহেদ আলম। 

উদ্বেগ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে ৩ মোবাইল অপারেটরের চিঠি