পেপ্যাল না থাকায় ক্ষতি কী?

ইন্টারনেটে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের ২৫টিরও বেশি মুদ্রাতে লেনদেনের সুযোগ দেয় পেপ্যাল। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই অনলাইন পেমেন্ট প্রসেসিং সেবাটি বাংলাদেশে চালুর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৫ সালে। তবে এক দশক ধরেই শোনা যাচ্ছে ‘পেপ্যাল আসছে’। মাঝে মাঝেই এ নিয়ে খবর হতে থাকে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে পেপ্যালের চুক্তি হয়। ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় দেশে পেপ্যাল চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। তবে তখন পেপ্যাল এর বদলে চালু হয় এর সাবসিডিয়ারি সার্ভিস ‘জুম’।
কিন্তু এই সেবাটি শুধু ‘রেমিটেন্স ইনবাউন্ড’ হওয়ায় তুষ্ট হতে পারেননি ফ্রিল্যান্সাররা। এরপর ২০১৯ ও ২০২২ সালে দুই দফা বাংলাদেশে পেপ্যাল আসার শোরগোল ওঠে। তখন সীমিত পরিসরে ওয়াইজ, স্ক্রিল ও স্ট্রাইপ ব্যবহার কতে দেখা যায় মুক্তপেশাজীবি রেমিটেন্স যোদ্ধাদের। তাদের তোপের মুখেই ২০২৫ সালের মধ্যে পেপ্যাল চালুর ঘোষণা দেন গণঅভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
একাধিক ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে আলাপ করে জানাগেছে, ফাইবার, আপওয়ার্ক ও ফ্রিল্যান্সার -এ PayPal ছাড়া সরাসরি টাকা তোলা কঠিন হওয়ায় বর্তমানে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ এক্সচেঞ্জ বা ভিন্ন দেশের PayPal আইডি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে পেপ্যাল নিয়ে বছর জুড়েই থেমে থেমে তেঁতে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া। বিভিন্ন পোস্টে তরুণ ফ্রিল্যান্সার ও স্টার্টআপরা আন্তর্জাতিক পেমেন্ট না পেয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ আবার সরকার অনুমোদিত পেয়নিয়ার তাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে বলে এ নিয়ে উচ্চবাচ্চ করেন না। অনেকে আবার ঝুঁকি নিয়েই অনলাইন ব্যবসায়ী বন্ধু/আত্মীয়ের নাম দিয়ে বা ইউএই/ইউএস ভিত্তিক পরিচয় দিয়ে পেপ্যাল ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ ওয়ার্কঅ্যারাউন্ডে থার্ড-পার্টি এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম যেমন EasyWayBD থেকে PayPal ডলার কিনে বিক্রি ও স্থানীয় পেমেন্ট মাধ্যমে (বিকাশ, নগদ, ব্যাংক ট্রান্সফার) রেমিটেন্স সংগ্রহ করেন। তবে এই ধরনের সলিউশনেও PayPal-এর টার্মস ভায়োলেট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এবং স্ক্যাম/ফ্রোডের ঝুঁকি থাকে।
এমন পরিস্থিতিত্বে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর প্রকৌশলী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব পেপ্যাল না আসার প্রকৃত কারণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, আগের সরকার “পেপ্যাল আসবে” বলে বড় একটি দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল। আরও বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে, অর্থের অপচয় করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কেননা-“পেপ্যাল না আসার বেশ কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ আছে”। তিনি বলেন, অনমনীয় ফাইন্যান্স নীতি, অ্যাড্রেস যাচাইয়ের অভাব, ভারতীয় অফিসের নিষ্ক্রিয়তা এবং আমাদের এখানে ফাইন্যান্সিয়াল সেটেলমেন্টের ব্যবস্থা না থাকায় এতো দিনেও পেপ্যাল আসেনি।
তবে চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে এ নিয়ে অগ্রগতি আশার করেছিলেন তিনি। আর বছরের মাঝামাঝি এসে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে ট্যাগ করে মঙ্গলবার পেপ্যাল-কে নিয়ে খোলা চিঠি লিখলেন জুলাই অভ্যূত্থানে শহীদ ফ্রিল্যান্সার মুগ্ধর ভাই ও জুলাই ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান। সেখানে তিনি বলেছেন, “এই একটি সমস্যার কারণে (পেপ্যাল না থাকা) আমরা বহু আন্তর্জাতিক কাজ হাতছাড়া করি। মার্কেটপ্লেসের বাইরে অনেক ক্লায়েন্ট এবং কোম্পানি কাজ দিতে চাইলেও PayPal-এর অনুপস্থিতির কারণে আমরা সেই সুযোগগুলো গ্রহণ করতে পারি না। মার্কেটপ্লেসে কাজ করলেও উচ্চ কমিশন দিতে হয়, যা ফ্রিল্যান্সারদের এবং দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য ক্ষতিকর।”
তবে “পেপ্যাল নিয়ে এসব 'ক্ষোভ' একেবারেই অমূলক” বলে মন্তব্য করেছেন বেসিস এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির। তিনি বলেছেন, পেপ্যাল-এর নিজের সার্ভিস জুম বাংলাদেশে চালু আছে। পেপ্যাল-এর মাধ্যমে যে কোন পেমেন্ট বাংলাদেশে আনতে হলে জুম-এর মাধ্যমে অনায়াসেই আনা যায়। পেপ্যাল-এর ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেই আমি এটা নিশ্চিত করেছি। এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এছাড়া বেসিস-এর উদ্যোগে লঞ্চ করা পেওনিয়ার, মাস্টারকার্ড ও ব্যাংক এশিয়ার যৌথ কার্ড "স্বাধীন"-এর মাধ্যমেও ফ্রিল্যান্সাররা টাকা দেশে আনতে পারেন।এগুলো ছাড়াও অনেকগুলো ব্যাংকের ERQ আকাউন্টেও টাকা আনা যায় সহজেই।”
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে পেপ্যাল না আসার কারণ সবচেয়ে বড় কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার পাঠানো উপর রেস্ট্রিকশন। নেপাল ও পেপ্যাল আছে, শ্রীলংকায় আছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কারণটা যৌক্তিক। এত কম বৈদেশিক রিজার্ভ। এটা আসলে ৭৫ বিলিয়নে না গেলে বাংলাদেশ কিছু করতে পারবে না। পেপ্যাল চায় টাকা আসতে ও যেতে বাঁধা দিতে পারবে না। অটোমেটিক সেটেলমেন্ট হতে হবে। ২৪/৭ রিয়েল টাইম সেটেলমেন্ট। আমাদের ভিতরকার সিস্টেম ও পলিসি প্রস্তুত না। আর এরা সেকেন্ডারি আরেকটা বিষয় চায় কাস্টমারদের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন। আমাদের রিজার্ভ ৭৫ বিলিয়ন হওয়ার আগে যাওয়া আমাদের আত্মঘাতী হবে। পেপ্যাল গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম বলে কতটুকু সে আমাদের সাথে ছাড় দিবে, আদৌ ছাড় দিবে কিনা এটাও প্রশ্ন। আমি জানি না সরকারের সাথে এখন কি অবস্থা। আমাদের অর্থনীতির টার্গেট হওয়া উচিত ৭৫ বিলিয়ন বৈদেশিক রিজার্ভ। আমাদের এক্সপোর্ট লাগবে। ভিয়েতনামের এখন মনে হয় কমে ৭১ বিলিয়ন হয়েছে।
অপরদিকে সিনেসিস আইটি’র গ্রুপ সিইও রূপায়ন চৌধুরী মনে করেন, আমি এটা নিয়ে একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছিলাম। পেপ্যাল দেশে আনা যায় কিভাবে। জুমদিয়ে পেপ্যালের টাকা আনা যায়, জুমএ পেপ্যাল দিয়ে লগইন করা যায়, টাকাও সেন্ড করা যায়। সমস্যা হচ্ছে জুম মাত্র ৩৭ দেশ থেকে মানি পাঠানো যায়। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, সাউথ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, ও সিঙ্গাপুর থেকে আপনি জুম দিয়ে টাকা পাঠানো যায় না। সমস্যা হচ্ছে অনেক মাধ্যম আছে কিন্তু কাস্টমারের অভ্যস্ততা। এই ফ্রি ল্যান্সিং এতটা রেড ওশেন মার্কেট আপনি যদি এই মুহূর্তে কাজ না ধরেন সেটা মুহূর্তে অন্য কারও কাছে চলে যায়। সেই সময় কাস্টমার যদি দেখে টাকা দিতে সমস্যা হবে সে অন্য একটা সার্ভিসের কথা বলছে যেটা সে নাম শুনেনি, কাস্টমার আমার জন্য এটা এক্সপ্লোর করবে না। জুম ছাড়াও অনেক প্ল্যাটফর্ম আছে। কিন্তু কাস্টমাররা পেপ্যালে টাকা দিবে। কি করবেন বলেন। আমি শিউর, পেপ্যাল আসলে ফ্রিল্যান্সিং এ একটা ভাল ইকোনমিক বুস্ট হবে। কারণ কাস্টমাররা এটা ইউজ করতে অভ্যস্ত।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএ) সভাপতি ডা. তানজিবা রহমান বললেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত পেপ্যাল। আমাদের দেশের এর সাবসিডিয়ারি জুম থাকলেও। এতে কেউ পেমেন্ট দেয় না। আর বিভিন্ন ভাবে পেমেন্ট দেশে আনতে গিয়ে আমাদের ৫ শতাংশ বেশি খরচ হয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্ট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্কো) সভাপতি তানভীর ইব্রাহিম বলেছেন, পেপ্যাল না থাকায় বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা এবং বিপিও কোম্পানিরা আন্তর্জাতিক পেমেন্ট পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন। এর ফলে কাজের সুযোগ হারান কারণ অনেক ক্লায়েন্ট পেপ্যাল ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, জটিল ও ব্যয়বহুল বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে বাধ্য হন, উচ্চ ফির কারণে আয় কমে যায়, এবং এমনকি মেধাবীরা উন্নত পেমেন্ট সুবিধার জন্য অন্য দেশে চলে যেতে পারেন।
অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ পেতে পেপল আবশ্যিক কোনো বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন। তিনি বলেন, পেপালের মতো একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরম থাকলে ভালো, কিন্তু পেপ্যাল না থাকায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে সেটা বোধকরি সঠিক নয়। বর্তমানে এর অনেক বিকল্প তৈরী হয়ে গেছে। এর চেয়েও অ্যাডভান্সড প্রযুক্তির ও কম খরচের সল্যুশন রয়েছে। বরং ক্রস বর্ডার পেমেন্টের ক্ষেত্রে পেপ্যাল অনেক বেশি চার্জ করে। তাছাড়া বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে বেশি কাজ করে। এখানে পেওনিয়্যার এবং প্রিয় পে-র মতো সেবা রয়েছে। আর প্লাটফর্মের বাইরে কাজ করলে সরাসরি পেমেন্ট নেয়ারও বিকল্প রয়েছে। এটা তেমন কোনও সংকট নয়!
পেপ্যাল এলে ‘বাংলাদেশ থেকে বাইরে ডলার পাঠানো উন্মুক্ত করা লাগতে পারে। তাতে ডলার কেনাবেচা বাড়তে পারে’ শঙ্কা প্রকাশ করে এই ফিনটেক উদ্যোক্তা বলেন, মার্কেট প্লেসের বাইরে আমেরিকার কোনো ক্লায়েন্ট থেকে টাকা নিতে বাংলাদেশে বসেই আমেরিকার ব্যাংকেই নিজ নামে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ রয়েছে প্রিয় পে-তে। ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলে নিজের ব্যাংকে দেশে টাকা আনতে পারেন ফ্রিল্যান্সাররা। সাথে পাচ্ছেন মাস্টারকার্ড, যা দিয়ে পৃথিবীর নানান দেশে পেমেন্ট করা যায়। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই এগুচ্ছে - অনেক অপশন তৈরী হচ্ছে।
সূত্রমতে, পেপ্যাল এর মাধ্যমে স্টারলিংক বাংলাদেশে পেমেন্ট নিতে আগ্রহী বলে জানাগেছে। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। তবে সেবাটি চালুর ক্ষেত্রে বড় যে তিনটি বাধা সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।