বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫। তৃতীয় দিন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুর ৪ মিনিটের মাথায় ডাক পড়লো বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থাপনা দেবেন তিনি। সাদা শার্ট-টাই আর কালো শ্যুটের কৃষকায় তরুণটি মঞ্চে আসতেই পেছনে ভেসে উঠলো চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুণ। নিচে চার লাইনের ডেজিগনেশন। কথা শুরু করলেন তিনি। কিন্তু কাজ করছে না মাইক্রোফোন। বুঝতে পারলেন যান্ত্রিক ত্রুটি। সাবলীল ঢংয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চের পেছনে গেলেন।
সেখান থেকে ২০ সেকেন্ডর মধ্যে বলতে ফিরলেন, “হ্যা, কারিগরি ত্রুটি ছাড়া যে কোনো অনুষ্ঠান জাস্ট সময়ের অপচয়।” বলতে বলতেই আবার শব্দ বিচ্ছিন্নতা। এবার শরীরটাকে একটু মোচড় দিয়ে ফের ফিরে গেলেন স্টেজের পেছন দিকে। আবারো ২২ সেকেন্ডের বিচ্ছিন্নতার পর শোনা গেলো- হ্যালো, হ্যালো। পুরো ত্রুটিকেই উড়িয়ে দিয়ে আশিক বললেন, আসলে এই কারিগরি ত্রুটি আমাদের ইচ্ছাকৃত, যাতে আপনাদের একটু ওয়ার্ম-আপ হয়ে যায়!”
এই সময় দ্বিতীয় দফায় হলজুড়ে হাসির রোল পড়ে যায়। উদ্দাম হাসতে দেখা গেলো প্রথম সারিতে বসা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসকে। সেটা উপোভোগ করতে করতে
বিমানে ৪১ হাজার ৭৯৫ ফুট উচ্চতায় উঠে শূন্যে লাফ দিয়ে দেশের পতাকা ওড়ানো এই স্কাইডাইভার বললেন, শুভ সকাল সবাইকে। চলুন আরেকবার একটু উপোভোগ করি। এরপর উপস্থিতিদের ধন্যবাদ জানিয়ে সবাইকে ঠিকঠাক জায়গা দিতে না পারায় ক্ষমাও চাইলেন।
এভাবেই করিগরি ত্রুটিকে উপস্থিত বুদ্ধি আর রসবোধ দিয়ে পুরো পরিবেশকেই নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে নিলেন আশিক। এরপরই যেন বিরক্তির বদলে আশিকের প্রেমে পড়ে গেলেন দর্শক-শ্রোতারা।
উপস্থাপনাতেও যেন শেষ থেকে শুরু করে চমকে দিলেন বিডা চেয়ারম্যান। ছবিতে উড়ে যাওয়া বিমানের দৃশ্য, সংসদস ভবন, মানচিত্র আর প্রবাহমান লেকের পাশ দিয়ে চওড়া সড়ক। বললেন, কল্পনা করুন, আমরা ২০৩৫ সালে। তখন এখানে হবে ১০ম বিনিয়োগ সম্মেলন। তখন এখানে বিকাশমান অর্থনীতি নিয়ে আলাপ হবে না। কথা হবে আঞ্চলিক ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ার হাউজ নিয়ে যা সংযুক্ত করবে প্রাচ্য ও প্রাতীচ্যকে। সেতুবন্ধন গড়ে তুলবে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর।
এর প্রস্তুতি হিসেবে গত আট মাসের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন আশিক। শুরুতেই দেখালেন ৫ আগষ্টের রাজপথ। যেখানে তরুণেরা স্বচ্ছতা, সুযোগ, গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। তাই আজ তাদের চাহিদা তুঙ্গে। আজকের তরুণরা শুধু দেশ নয় বিশ্ব নাগরিক। টুইটিং, টিকটক করে তারা এখন সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে যুক্ত। তাই আগামী ৫-১০ বছরে আমরা কিভাবে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর হতে পারি সেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর এই চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য রয়েছে দেশো ১৮ কোটি মানুষ। যাদের অর্ধেকের বেশি বয়স ২৫ এর নিচে। এ কারণেই এই দেশে বিনিয়োগ বিশ্বের যে কোনো দেশের বিনিয়োগের চেয়ে গড় প্রাপ্তির হার বেশ বেশি। ফলশ্রুতিতে আজ ঘণ্টা খানেক আগে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের একটি স্টার্টআপ শপআপ সৌদি আরবের সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল শাখা সানাবিল ইনভেস্টমেন্টস থেকে ১১ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পাচ্ছে।
এসময় গৌরবের চিৎকার আর করতালিতে মুখর হয় স্টেজ। সরকারের উপদেষ্টাদের পাশাপাশি এতে অংশ নিতে দেখা যায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রীসহ প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং অপরাপর দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের।
আশিক বললেন, এটা আজকের কথা। কিন্তু আগামীকাল কী হবে? নিজের প্রশ্নের জবাবে জানালেন, এজন্য ১৮ কোটি জনগণ যথেষ্ট নয়। আমাদের বাজারকে নতুন করে সঙ্গায়িত করতে হবে। কেননা এই বাজার আরো অনেক অনেক বড়। বাংলাদেশের বাইরের সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক বাজারের দিকে তাই নজর দিতে হবে। মানচিত্রে তখন ভেসে উঠলো বাংলাদেশে স্থাপিত কারখানা থেকে বঙ্গপসাগর থেকে নেপাল, ভুটান, ভারতের সাত রাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য সরবরাহের। আর সেই সক্ষতমতার বয়ান তুলে ধরে দেখানো হলো চট্টগ্রামের ৫টি ইপিজেডের সক্ষমতা আগামী কয়েক বছরেই বেড়ে যাবে তিন গুণ। অচিরেই বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বৃহত্তম লজিস্টিক্যাল হাব।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের আস্থায় আনার বিষয়টি তুরে ধরে এজন্য করণীয় ট্রু ওয়ান স্টপ সার্ভিসের রূপরেখা তুলে ধরেন বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান। এই ওয়ানস্টপ সার্ভিসটি দুইট ভাগে বিভক্ত। একটি মানুষ, অপরটি ডিজটাল এলিমেন্ট।এই দুই এলিমেন্ট একটি স্খানে নিয়েই বিনিয়োগকারীদের সামনে উপস্থাপন করা হবে। এনবিআর-এ স্থাপন করা হবে অথরাইজড ইকোনোমিক অপারেটর (এইও) হেল্প ডেস্ক। সবশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি ক্লাবের অধীনে এনে আমরা বিনিয়োগকারীদের সমাধান দেবো। এর মাধ্যমেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে সেতুবন্ধন রচনা করবো। এজন্যই গঠন করা হবে প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল।