ইন্টারনেটের দাম ৩ শতাংশ বাড়ার শঙ্কা?

ইন্টারনেটের দাম কমানোর সঙ্গে মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় নিজেদের স্থাপিত টেলকো ফাইবারের প্রতি কোরের ব্যবহারের ভাড়া ‘সমন্বয়’ করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে প্রতি বছর ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পর এই দরপত্রকে ‘সমন্বয়’ নয় ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে দেখছেন ভাড়াটিয়ারা।
ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের মতে, গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমাতে বলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই যদি দাম বাড়ায় তাহলে এমন উদ্যোগ বুমেরাং হতেই পারে। ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানাগেছে, সম্প্রতি গ্রাহক পর্যায়ে ৬৬ শতাংশ দাম কমাতে ব্যাবসায়িদের সঙ্গে আলাপ করেছে বিটিআরসি। কিন্তু দাম কমানোর কোনো পথ তারা খোলা দেখছেন না। কেননা, তাদের আয়ের ১০০ টাকার মধ্যে ৬৬ টাকাই বিভিন্ন ধাপে জমা দিতে হয় সরকারি কোষাগারে। বাকি ৪৪ টাকা দিয়ে বাকি সব খরচ, সেবা ব্যয়, বেতন দিয়ে এখন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা।
এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ে ও পিজিসিবি’র লাইন ব্যবহার করবেন কি না তা নিয়েই নতুন করে ভাবতে চাইছেন ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) সেবাদাতা ও মোবাইল অপারেটররা (এমএনও)।
এদিকে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি’র (পিজিসিবি) পর নতুন করে ভাড়ার দরপত্র প্রকাশ করে গত ১৬ জুন ফাইবার অপটিক ক্যাবল ইজারার ক্ষেত্রে এনটিটিএন ও মোবাইল অপারেটরদের জন্য কোর ক্যাবল ব্যবহারের নতুন দর প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে এই দর নিয়মতান্ত্রিক ও দাম সমন্বয় করে করা বলে দাবি সরকারি প্রতিষ্ঠানটির। তারা বলছে, ২০২১ সালের পর ২০২৫ সালের জুনে এসে বাজার মূল্য সমন্বয়য়ের ফলে এখন প্রতি মাসে প্রতি মিটারের মাসিক কোর ক্যাবল ভাড়ার ক্ষেত্রে গড়ে ১ টাকা করে বেশি খরচ গুণতে হবে এমএনও ও এনটিটিএনদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (টেলিকম) সুশীল কুমার হালদার ডিজিবাংলাটেকডট নিউজকে বলেছেন, দাম বাড়ানো নয়, বিভিন্ন সেকশনের কোরোর মান অনুযায়ী বেস্ট প্রাইস সমন্বয় করা হয়েছে। ২০২১ সালে দাম ছিলো সর্বোচ্চ ৩ টাকা ৫০ পয়সা। এখন সেই দাম সমন্বয় করে সর্বোচ্চ ৪ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। ফলে এনটিটিএন ও মোবাইল অপারেটরদের আমাদের কোর ক্যাবল ব্যবাহারে আগের ৩ টাকা ৫০ পয়সার স্থলে এখন পার মিটার, পার কোর ও পার মান্থ সর্বোচ্চ ৪ টাকা ৫০ পয়সা দিতে হবে।
তবে যে ভাবে দাম বাড়ছে আর ডাটার প্রাইস কমাতে বলছে তা নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সঞ্চালন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাহন লিমিটেড এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ। ডিজিবাংলাটেকডট নিউজ এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, এটা জান্টিফাইড না। এম্নিতেই তো প্রতি বছর ৫ শতাংশ করে ভাড়া বাড়ানো হয়। এখন আমাদের সব মিলিয়ে প্রতি মিটিার কোরে ভাড়া সাড়ে ৯টাকা করে পড়ে। এরপর যদি সমন্বয় এর নামে দাম বাড়ানো হয় তাহলে ইন্টারনেটের দাম কমবে কিভাবে? তাই যেসব কারণে ইন্টারনেটের দাম বাড়ছে সেগুলোতে হাত দিতে হবে। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি দাম বাড়ায় আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিভাবে কি করবো?
এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া নেয়া বাদ দিয়ে নিজেরাই ফাইবার স্থাপন করে সেবা দেয়াকেই এখন দীর্ঘ মেয়াদী সল্যুশন হিসেবে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
একই বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এমটব) মহাসচিব লে কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার বলেছেন, ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবাকে সহজলভ্য ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হলে বিভিন্ন স্তরে খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। মোবাইল অপারেটররা যেসব অবকাঠামো ও পরিষেবা সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে যদি মূল্য বৃদ্ধি ঘটে, তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পুরো খাতে পড়বে এবং গ্রাহক পর্যায়ে সেবার মূল্য বাড়বে। একদিকে সরকার গ্রাহক পর্যায়ে খরচ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন স্তরে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে—যা একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। টেলিকম খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং গ্রাহকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা পৌঁছাতে আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় অপারেটরদেরও ফাইবার স্থাপনের সমান সুযোগ দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।"
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নীতিমালা অনুযায়ী, এনটিটিএন সেবা ভাড়া বা ইজারার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ট্যারিফ কমিশনের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারণ করা যায় না। কমিশন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে এখনো এই নতুন দরের অনুমোদন নেয়নি। তবে দু-এক দিনের মধ্যে বিটিআরসির অনুমোদন নিয়ে নেবেন বলে জানিয়েছেন সুশীল কুমার হালদার। সূতমতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৭১ কিলো মিটার ক্যাবল ভাড়া নিয়েছে গ্রামীণ ফোন।
এই অনুমোদনের পর যদি বাংলাদেশ রেলওয়ে নতুন ট্যারিফ কার্যকর করে তবে তার বড় ধাক্কা খাবে এই অপারেটরটি। তবে আরো বড় ধাক্কা লাগবে গ্রাম গঞ্জের ইন্টারনেট ব্যবহারকারিদের ইন্টারনেট দামে। এ বিষয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম ডিজিবাংলাটেকডট নিউজ-কে বলেছেন, টোট্যাল ভ্যালুচেইন হিসেবে এই খরচের ভার গ্রাহক পর্যায়ে তো পড়বেই। কেননা গ্রামে গঞ্জে ইন্টারনেট ট্রান্সমিশনের সবচেয়ে বেশি নেটওয়ার্ক রয়েছে রেলওয়ের। এই নেটওয়ার্ক দিয়েই ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হয়। এখন এনটিটিএনগুলোর লংহল ট্রান্সমিশনের খরচের চাপ আমাদের ওপর ঠেলে দিলে গ্রাম- গঞ্জে ইন্টারনেট খরচ বাড়বে ৩-৪ শতাংশ। একইভাবে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন বাধাপ্রাপ্ত হবে।
প্রসঙ্গত, আসছে জুন থেকে গ্রাহকপর্যায়ে সর্বনিম্ন ৪০০ টাকার প্যাকেজ করতে আইএসপিদের বলেছে বিটিআরসি। এমন পরিস্থিতিতে একের পর এক খরচ বৃদ্ধি ও সরকারি কোষাগারে আয়ের সিংহভাগ দিয়ে ব্যবসা করতে হলে ৮০০ টাকার কমে কোনো প্যাকেজ রাখা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা।