ডিজিটাল রূপান্তর এবং এমএসএমই খাতের প্রবৃদ্ধিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের প্রস্তাবনা তুলে ধরলেন ফাহিম মাশরুর

আইএসপিকে ডিজিটাল সেবাদাতা হিসেবে দেখতে চান বিটিআরসি চেয়ারম্যান

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  
আইএসপিকে ডিজিটাল সেবাদাতা হিসেবে দেখতে চান বিটিআরসি চেয়ারম্যান

দেশের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে একেকজন গ্রাহককে শতকরা ৪২ টাকা কর দিতে হয়। একই ভাবে ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার করে বিটিআরসি। ফলে এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আয়ের ১০০ টাকার মধ্যে ৬০ টাকা চলে যায় সরকারের পকেটে। এতে কেবল ব্যবসায়ীরাই নয় সরকারও বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। তাই ইন্টারনেটের দাম কমাতে হলে এই খাতের পূনর্গঠন জরুরী। এজন্য এই সেবায় ইন্টারঅপারেবল, ওপেন টেকনোলজি স্ট্যান্ডার্ড এবং ইক্যুইটেবল অ্যাকসেস নিশ্চিত করতে পরামর্শ দিয়েছে ‘অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস বিষয়ে টাস্কফোর্স। 

সোমবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে রাজধানীর ব্রাক সেন্টারে শুরু হওয়া দুইদিনব্যাপী এ সংক্রান্ত সুপারিশ সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এমনটাই জানিয়েছেন ১২ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটির অন্যতম সদস্য বিডিজবস সহ প্রতিষ্ঠাতা ও বেসিস এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর। এসময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলে ধরে টাস্কফোর্সের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, মোবাইল ইন্টারনেটের উচ্চ মূল্য, গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ, ২০টির অধিক লাইসেন্সিং লেয়ার থাকা এবং দেশে ইন্টারনেট আমদানিতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট মাত্র দুইটি এনটিটিএন কোম্পানির কারণে এক দশকেরও বেশি সময়ে প্রান্তিক অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছতে পারেনি।

এমন অনুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটের উৎপাদনশীল ব্যবহার বাড়ানো এবং আইএসপি-কে কানেক্টিভিটির পাশাপাশি ডিজিটাল সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী।

দেশে ইন্টারনেটের উৎপাদনশীল ব্যবহার হচ্ছে না উল্লেখ করে প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি বলেন, ব্যবহৃত সাড়ে ৬জিবির মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ ডেটা ইনফোটেইনমেন্ট সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মতো কাজে ব্যবহৃত হয়। এর কারণ মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে নয় করপোরেট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ডিজিটাল সেবার ভ্যুলু তৈরি করা হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ গ্রামের একজন ছেলে বসে বসে বিপিএল দেখছে। এটা ভালো। কিন্তু বিপিএল-এ বাজি ধরার চেয়ে এই মৌসুমে কোন বীজ, সার কোথায় পাওয়া, অনলাইন ঋণ ইত্যাদি খোঁজার কথা। কিন্তু বড় কোম্পানিগুলো সেই কাজটা করছেন না। 

বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, নব্বইয়ের দশকে অন্তর্ভূক্তি এবং সংযুক্তি হাতে হাত ধরে এগিয়েছে। এসডিজি থেকে এমডিজিতে উত্তরণের এই সময়ে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডেটা। পৃথিবী জুড়ে যখন শীতল যুদ্ধ চলছিলো তখন দেখা গলো, কেবল সরকারি উদ্যোগে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বেসরাকির উদ্যোগকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। তখনই রেগুলেটরের প্রয়োজন হলো। একসময় নেটওয়ার্কের মধ্যে অনেক গুলোর মধ্যে প্রচুর গেইটওয়ে তৈরি হওয়ায় দায়বদ্ধতার প্রয়োজন হলো। তাই লাইসেন্স কমিয়ে আনলেও ওদের দিকটা ফেবার করা উচিত। ২০১০ সালে টেলিকম নীতিমালায় সরকারের অনুমোদনক্রমে বিটিআরসি’কে পরিচালিত হতে হলো। ফলে তখন অনেক অপ্রত্যাশিত লাইসেন্স দেয়া হলো। এখন সেই ল্যাসেন্সগুলোই দাম কমানোর পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছে, আজকের দিনে টেলিকম হচ্ছে একটি সুবিধা প্রদানকারী সহায়ক খাত। প্রতিটি খাতই এই খাত থেকে সুবিধাভোগ করছে। তাই এই খাতে যারা ব্যবসা করবেন তাদের কাছে ভোক্তা সংখ্যা বড় হওয়ার নয়। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত- ভোক্তাদের বিনিয়োগ সহযোগী হওয়া। 

এই দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে বিটিআরসি সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মধ্যে বৈষম্যঘুচে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে বলে জানান চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী। তিনি বলেন, আমরা এই তিন পক্ষের মধ্যে বৈষম্য চিহ্নিত করেছি। আমরা এখন ভোক্তা সেবাকে টেকসই করতে এখন প্রতিটি অংশকে সমান অংশীদারিত্বে গুরুত্ব দিচ্ছি। এজন্য নেটওয়ার্ক টপোলজিকে একেবাইরে সাধারণ করতে যাচ্ছি। আগামী মার্চের শেষে বা এপ্রিলে এটি করা সম্ভব হবে।

এর আগে ডিজিটাল রূপান্তর এবং এমএসএমই খাতের প্রবৃদ্ধিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন নিয়ে দেয় উপস্থাপনায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নাগরিক সেবায় দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করে ফাহিম বলেছেন, ডিজিটাল সেবার নামে আমরা নানা মুখরোচক গালগল্প শুনেছি। এজ্ন্য বেশি কিছু ভুল নীতিমালাও হয়েছে। তারপরও আমরা জনগণের দোর গোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে পারিনি। সুশাসন ও স্বচ্ছতার অভাবে এটা সম্ভব হয়নি। যতই আমার ডিজিটাল রূপান্তর ও স্বচ্ছতার কথা বলি না কেন এখনো স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতের মতো বিভিন্ন খাতে প্রযুক্তি ভিত্তিক সমাধানের জন্য দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। 

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা কায়রো-তে এআই ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন কিন্তু এর জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত কি না সেই প্রশ্ন রাখেন এই প্রযুক্তি ব্যবসায়ী।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, রোবটিকস এবং এআই এর মতো যে প্রযুক্তিগুলো আসছে সেই দিক থেকে আমাদের পোশাক শিল্প খাত সহ অন্যান্য রফতানি খাতের প্রতিযোগিতা মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত?

ফাহিম বলেন, বেকারত্ব ইস্যুতেই জুলাই আন্দোলন হয়েছিলো। তারপরও এখনো আমারা লক্ষ লক্ষ্য বেকার তরুণ এবং স্নতকধারীদের  দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য প্রকৃত অর্থে কিছুই করছি না। ভবিষ্যত সফলতার জন্যই আমাদের ডিজিটাল স্ট্রাটেজি ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে সুলভ ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, উদ্ভাবন সংষ্কৃতি ত্বরান্বিত করতে নির্ভরযোগ্য ও টেকসই ডিজিটাল জনকাঠামো স্থাপন এবং ডিজিটাল সেবা দেয়ার মতো উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত টেনে তিনি আরো বলেন, দেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে। এর মধ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী প্রান্তিক অঞ্চলে থাকেন। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এবং জনবহুল ইন্দোনেশিয়ার থেকে আমাদের ইন্টারনেট ব্যভহার ও ডিভাইসে মালিকানার হার ৩০ শতাংশেরও কম। এরমধ্যে মোবাইলে ৬.৫ জিবি ডেটা ব্যবহার করেন মোবাইল ব্যাবহারকারীরা। আর শহরে বেশি ব্যবহৃত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ডেটা ব্যাবহারের পরিমাণ ১৫০জিবি। গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ ২০ শতাংশের বেশি ডেটা ব্যবহার করেন।   

এই পরিসংখ্যানের প্রসঙ্গ তুলে টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মুস্তাফা মাহমুদ হুসাইন বলেন, মাত্র ৫০০ টাকায় যারা আনলিমিটেড ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছেন তারা দেশীয় উদ্যোক্তা। এই ৫০০ টাকার মধ্যে ৩০ শতাংশ এনটিটিএন, ২০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ খরচ এবং বাকিটা এইচআর কস্ট হিসেবে ব্যয় করে। এই টাকাটা পুরোটাই দেশের মধ্যে থাকে। 

মূলপ্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বিআইডিএস এর গবেষক ড মঞ্জুর, টালিখাতার সিইও ড. শাহাদাত খান, টেলিকম বিশেষজ্ঞ রাকিবুল হাসান, চালডাল ডটকম সহ প্রতিষ্ঠাতা ওয়াসিম আলিম, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যাসোসিয়েশন প্রেসিডেন্ট শওকত হোসেন, গ্রামীণ ফোনের সিনিয়র ডিরেক্টর হোসেন সাদাত, রবি’র কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ সাহেদুল আলম, ব্রেইন স্টেশনের সিইও রাইসুল কবির প্রমুখ।  

অনলাইনে সংযুক্ত ছিলেন আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী।  প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন শেয়ারট্রিপ সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী সাদিয়া হক, এসএমই ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাজিম সাত্তার, বাংলাদেশ ব্যাংকের নওশের আলী, টেলিকম বিশেষজ্ঞ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ম্যানেজার মিস মার্টিন প্রমুখ।