ইন্টারনেটের দাম কমাতে
পর্বতের মূষিক প্রসব

সেবাদাতা ও গ্রাহকের আপত্তির মুখে গত ২২ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো ব্রডব্যান্ড সেবায় ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ থেকে সরে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেই ফাঁকে গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ দাম কমাতে অর্থমন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি)। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকার পাঁচ এমবিপিএস সংযোগ ৪০০ টাকায় পাবে গ্রাহক।
অবশ্য এ বিষয়ে কিছুই জানেন না ইন্টারনেট সেবাদাতারা। তারা জানিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি তাদের সঙ্গে। এছাড়াও এনটিটিএন ও আইআইজি পর্যায়ে দাম কমানো না হলে এই উদ্যোগ বুমেরাং হবে বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, এতে ইন্টারনেট সেবার মান কমবে এবং একইসঙ্গে অবৈধ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়বে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের প্রশ্ন, ইন্টারনেটের মান যদি ঠিক না থাকে তাহলে কম দামের ইন্টারনেট দিয়ে কি হবে?
তহালে কেন এই উদ্যোগ- প্রশ্নের উত্তর মেলানো সম্ভব হয়নি। কেননা, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম তুলনামূলক ভাবে কম।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দামের তুলনামূলক চিত্র
প্রতিষ্ঠান ও গতির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয় পাকিস্তানের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম। সাধারণভাবে সেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মাসিক খরচ পরে দেড় হাজার থেকে ৪ হাজার পাকিস্তানি রুপি। স্থানীয় অপারেটর পিটিসিএল, নয়াটেল, জাজ ও ওয়াতিন এর ওয়েবসাইট ঘেঁটে এ তথ্য মিলেছে। দেশটিতে ৫৯৯ রুপিতে মেলে ১ এমবি গতির প্যাকেজ যেখানে ডাউনলোড সীমা সর্বোচ্চ ১০জিবি। ৭৫০ টাকায় ২ এমবি গতির প্যাকেজে মেলে ১৫জিবি পর্যন্ত ডাউনলোডের সুযোগ। আর ১০০০ টাকায় আনলিমিটেড প্যাকেজে ১০০ এমবি গতির ইন্টারনেট সংযোগ।
ভারতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে সস্তা। সেখানকার ইন্টারনেটের বাজার বিশ্লেষষণ করে দেখা গেছে, সেখানে সর্বনিম্ন ৪ এমবি ইন্টারনেটের মাসিক প্যাকেজ মূল্য ৪৯৯ রুপি। সাধারণত সেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ রুপি বা তারও বেশি হয়ে থাকে। এছাড়াও ব্যান্ডইউথ ও নানা সুবিধা জুড়ে দিয়ে দেশটির থমাস বা জিও বিভিন্ন প্ল্যান দেয় যেগুলোর মধ্যে কোনোটাই এর নিচে নয়। এক্ষেত্রে তারা মানসম্মত সেবা দিতে ১০০ এমবিপিএস থেকে ১ গিগিবিট পর্যন্ত ইন্টারনেট দিয়ে থাকে। মাসে ৩৯৯ রুপিতে ৪এমবি থেকে ৩০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেয়। ভারতের বিএসএনএল। এক্ষেত্রে ডাউনলোড সীমা ১৪০০জিবিপিএস। অপরদিকে ৫৯৯ রুপিতে একই গতির যে ইন্টারনেট দেয়া হয় সেখানে ডাউনলোড সীমা ৪০০জিবি। আর আনলিমিটেড প্যাকেজে ৩৯৯ টাকা সর্বোচ্চ ৩০ এমবি, ৬৯৯ টাকায় ১০০ এমবি এবং ৯৯৯ টাকায় ১৫০ এমবি ইন্টারনেট দেয় জিও।
একইভাবে ভুটানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি। দেশটির প্রধান ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যে ভুটা ব্রডকাস্টিং সার্ভিস এবং দ্রুকনেট অন্যতম। ভুটানে ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে প্রায় ১০০০ থেকে ৩০০০ ভুটানি এনগুলট্রাম -এর মধ্যে হয়ে বেশি খরচের প্যাকে প্ল্যানগুলো ২০ এমবিপএস, ৫০ এমবিপিএস এবং ১০০ এমবিপিএস গতির হয়ে থাকে। নেপাল টেলিকম, এনসেল, ওয়ার্ল্ডলিংক ও স্মার্টলিংক এর ওয়েব সাইটের তথ্য বলছে, নেপালে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মাসিক খরচ প্রায় ১ হাজার থেকে ৪ হাজার নেপালি রুপি বা তারও বেশি হয়ে থাকে। তবে গতি এবং মানে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে নেপাল। সেখানে ১৩০০ রুপিতে মেলে ২০০ এমবি এবং ১৫৫০ রুপিতে ২৫০এমবি ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। তবে এর মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভূক্ত নয়। দেশটিতে ইন্টারনেট সেবায় লেয়ার কম থাকা এবং সরাকরি নীতি আনুকুল্যের কারণে এই সুবিধা মিলছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেবাদাতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ছাড়াই দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলে তা টেকসই হবে না, বরং বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। এসময় আনলিমিটেড মোবাইল প্যাকেজ চালুর ক্ষেত্রে বিটিআরসি’র ‘ইউটার্ন’ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের প্রশ্ন, বিটিআরসি কি ফ্যাসিস্ট কমিশনের পথেই পা বাড়াচ্ছে কি না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ।

বিষয়টি নিয়ে জনপ্রিয় অনলাইন চাকরির সন্ধানদাতা সাইট বিডিজবসের প্রধান, বেসিস এর সাবেক সভাপতি এবং বৈষম্যহীন ও টেকসই উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে গঠিত টাস্কফোর্স সদস্য এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ব্রডব্যান্ড দাম বাংলদেশে বেশি না। দাম বেশি মোবাইল ডাটাতে। বর্তমানে যে ২০% সম্পূরক শুল্ক আছে সেটা উঠিয়ে দেওয়া উচিত ডাটার ক্ষেত্রে। ভয়েস এর ক্ষেত্রে থাকতে পারে। আসলে আইএসপিদের দাম কমানোর কোনো সুযোগ নেই এখানে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমাতে হলে এনটিটিএন পর্যায়ে ড্রাস্টিক্যালি এবং আইআইজিতেও দাম কমাতে হবে। অন্যান্য কস্ট স্ট্রাকচার পূণর্বিন্যাস না করা হলে টোটাল ব্রডব্যান্ড কস্ট কমানো সম্ভব না। আর এতে ডিজিটাল বৈষম্য ঘুচানো যাবে না। মোবাইল ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে। কিন্তু সেটাও কঠিন। কেননা, সরকার শতকরা ৬০টাকা নিয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক বাজারে এখন ৪০০ টাকাতেও ব্রডব্যান্ড লাইন পাওয়া যায়। কিন্তু মান ভালো না। আমরা চাই কোয়ালিটি ইন্টারনেট। যে প্রক্রিয়ায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বিটিআরসি। এখন স্বৈরাচারী মনোভাবের ওপর চলছে। এটা হঠকারি সিদ্ধান্ত। তাই দিন শেষে কিছুই অর্জন হবে না।

একই স্বর প্রতিধ্বনিত হলো ভয়েস ফর রিফর্ম সমন্বয়ক ফিদা হক এর কণ্ঠে। তিনি বললেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যাপারে সবচেয়ে আগে দরকার সেবার মানের নিশ্চয়তা। এনটিটিএন ও আইআইজি পর্যায়ে দাম না কমিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম কমালে সেবার মান আরো নেমে যাবে বলে আশংকা করার যথেষ্ট কারণ আছে। আর মোবাইল ইন্টারনেটেরও দাম কমানোর দরকার আছে বলে মনে করি।

রাষ্ট্রচিন্তা সমন্বয়ক দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ইন্টারনেটের দাম কমাতে হলে আগে একটি রোড ম্যাপ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের চিহ্নিত করতে হবে। অথচ তা না করে কোয়ালিটিতে কমপ্রোমাইজ করা হচ্ছে। যা করা হচ্ছে তা সৎ আকাঙক্ষা থেকে করা হয়নি। ইল-ইন্টেনশনালি হচ্ছে। এটা ধোঁকাবাজির প্রচেষ্টা। বিটিআরসি’র অ্যাক্টিভিজম। এগুলো শঠতা। মনে হচ্ছে তারা পুরো বিষয়টা ভেস্তে দেবে। পরবর্তী সরকারের জন্য ভয়াবহ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে। আগের সরকার যেভাবে কাজ করতো এরাও তাই করছে।

বিটিআরসি’র ইন্টারনেট দাম কমানোর উদ্যোগ বিষয়ে প্রস্তুতি জানতে চাইলে ইন্টারনেটে সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি সভাপতি এমদাদুল হক বললেন, ইন্টারনেটের ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপের মতো বিষয় সুরাহা হওয়ার পর এমন খবর শুনছি। তবে এ নিয়ে কোনো বাজার গবেষণা বা আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানানে। অবশ্য কোনো আলোচনা ছাড়াই এটা চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা বিটিআরসি’র রয়েছে। এক দেশ এক রেটটাও এমন করেই হয়েছিলো। এতে নন লাইসেন্সিদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি ইন্টারনেটের কোয়ালিটি কমেছে। এতে গ্রাহক ও সরকার কেউই লাভবান হবে না। প্রকারন্তরে কমপ্লায়েন্স কোম্পানিগুলো ব্যবসা ছেড়ে দেবে।
কেন জানতে চাইলে তিনি হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, এককেটি ৫ এমবি’র সংযোগে ৫০০ টাকার প্যাকেজে কোনো লাভ নেই। ৫১০-২০ টাকা খরচ হয়। শেয়ার্ড লাইনে ১:৫ হলেও ৫ এমবিতে খরচ পরে ৩৯৮ টাকা। সরকারি খাতে ৬০ শতাংশ হিসেবে ২৩৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেই। এনটিটিএনকেই দিতে হয় ৬০ টাকা। করপোরেট থেকে যেটুকু ব্যবসা হয় তা দিয়ে কোনো মতে চলে। আমরা লাভ না করলেও সকল লেয়ার মিলে প্রতি মাসে ৩২০ কোটি টাকা রাষ্ট্রিয় কোষাগারে জমা দেই। এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দিয়েই উৎপাদনশীল কাজের গতি বারে। তাই এর ওপর চাপ আসলে পক্ষান্তরে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই প্রচ্ছন্ন চাপ পড়বে। এটা না বোঝার কিছু নেই। তাই বলতেই হচ্ছে- এটা বিগত সরকারের মতো সস্তা রাজনীতি। আমাদের ওপর এক দেশ এক রেট চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তখনো চাইনি এখনো চাই না। আমরা চাই প্রতিযোগিতা করে বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হোক। ৩ হাজার কোম্পানি আছে তারাই মুক্তবাজারে সেরা দাম নির্ধারণ করে নেবে।

একই মত ব্যক্ত করে আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া যুক্ত করলেন, কোন দেশে আমাদের চেয়ে কম দামে ব্রডব্যান্ড সেবা আছে আমার জানা নেই। এরওপর ২০ এমবির নিচের ন্যারোব্যান্ড নিয়ে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। এনটিটিএন চাপে লোকাল ডাটা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছতে যুদ্ধ করছি। সত্যিকারেই যদি ইন্টারনেটের দাম কমাতে হয় তবে এনটিটিএন ও আইআইজিতেও একদেশ এক রেট জারি হোক। একইসঙ্গে মোবাইল অপারেটর ও আইএসপিদের ব্যান্ডউইথ কেনায় বৈষম্য দূর হয়। তা না হলে ডিজিটাল ভোগান্তিতে নতুন পালক গজাবে। আসলে যে কোন প্রাইস বেঁধে দেওয়াটাই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে একটা মশকরার শামিল। এটা মুক্ত অর্থনীতিতে গ্রাহক সর্বোচ্চ কম দামে ভালো সার্ভিস খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিটিআরসি থেকে বেধে দেয়া মূল্য অনুযায়ী, আইএসপি পর্যায়ে আইআইজিদের ক্ষেত্রে প্রতি এমবি ব্যান্ডউইথের মূল্য ৩৬৫ টাকা এবং ব্যান্ডউইথ পরিবহনে প্রতিএমবি ২৫ টাকা নির্ধারণ করা আছে। যদিও বাজারমূল্য ভারসাম্য রক্ষায় আইআইজি’রা স্ব-প্রণদিত হয়ে এই মূল্য ২০০ টাকায় কমানো আবেদন করেও সাড়া পায়নি। তারপরও অনেক আইআইজি’ই বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এখন প্রতি এমবি ব্যান্ডউইথ ১৮০টাকায় বিক্রি করছে। তবে এনটিটিএন পর্যায়ে এই দাম ১০টাকার নিচে নামানো সম্ভব হলেও বিটিআরসি’র বেধে দেয়া ২৫ টাকার নিচে নামতে পারছে না। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাদাতারা চাপে পড়ছেন। তারা বলছেন, গ্রাহকের ঘরে ঘরে ওভারহেড লাইন টেনে সংযোগ দেয়ার মতো অরক্ষিত বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে থেকে দাম কমানো এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংযোগ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।