আলজাজিরা: মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনার প্রমাণ; আবু সাঈদ খুনের প্রামাণ্য ভিডিও

বিবিসি’র অনুসন্ধানি ফ্যাক্টচেকের পর এবার ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করলো আল জাজিরা। এ বিষয়ে গোপন ফোন কলের রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করে এই প্রমাণ দিয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানী ইউনিট। ফোন রেকর্ডিংয়ের ডিজিটাল ফরেনসিক করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ফোনালাপ রেকর্ডিংগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে কোনো কারসাজি করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্য অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট)। এ ছাড়া ভয়েস ম্যাচিংয়ের (কণ্ঠ মিলিয়ে দেখা) মাধ্যমে ফোনালাপকারীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রায় ৫০ মিনিটের ফ্যাক্টস ফাইল প্রতিবেদনে গোপন ফোনালাপের একাধিক কল রেকর্ডিং প্রকাশ করে ২৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। খবরে প্রকাশ, আন্দোলনের সময় এসব ফোনালাপ রেকর্ড করেছে শেখ হাসিনার নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি। এই সংস্থাটি এর আগেও কেবল বিরোধী নেতাদের নয়, বরং হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রদের ওপরও নজরদারি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী জানতেন তাঁর ফোনালাপ রেকর্ড করা হচ্ছে। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হতো, ফোনে এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা উচিত হবে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জবাব ছিল, হ্যাঁ, আমি জানি, জানি; আমি জানি এটা রেকর্ড করা হচ্ছে; সমস্যা নেই।’
প্রতিবেদনে ১৮ জুলাই রেকর্ড করা এই কল রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে তার এক সহযোগীকে ‘নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে বলতে শোনা গেছে। ফোন কলে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি একদম। এখন লিথাল ওয়েপনস (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সোজা গুলি করবে। ওইটা বলা আছে। আমি এত দিন বাধা দিয়ে রাখছিলাম...ওই যে স্টুডেন্টরা ছিল, ওদের সেফটির (নিরাপত্তার) কথা চিন্তা করে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ওই ফোনালাপে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ব্যবহারের কথাও বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘‘যেখানেই জমায়েত দেখা যাবে, ওপর থেকে, এখন তো ওপর থেকেই হচ্ছে—কয়েক জায়গায় শুরু হয়ে গেছে। কিছু বিক্ষোভকারী সরে গেছে।’’
সেই সময় বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর আকাশ থেকে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরীফ আল জাজিরার আই-ইউনিটকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে একটি হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর শরীরে অস্বাভাবিক ধরনের গুলি বিদ্ধের চিহ্ন পাওয়া যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলি বিক্ষোভকারীদের কাঁধে অথবা বুকে ঢুকে যায় এবং সেগুলো শরীরেই থেকে গেছে। সেই সময় আমরা এই ধরনের অনেক রোগী পেয়েছিলাম। এক্স-রে করে আমরা হতবাক হয়েছি যে, শিক্ষার্থীদের শরীরে অনেক গুলি ছিল।
তবে শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত হতে পারেনি আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান। হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভ ও সরকারের দমন-পীড়নে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা জানতেন তার কথোপকথন রেকর্ড হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময় অপর পক্ষ বলত, এই বিষয়ে ফোনে না বলাই ভালো। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলতেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে। কোনও সমস্যা নেই।’’
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘তিনি (হাসিনা) অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন সেই গর্তে তিনি নিজেই পড়ে গেছেন।’’
১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এটি আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্টে পরিণত হয়। পরে হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ফোনে সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে পুলিশের আইজিপিকে চাপ দিতে শোনা যায়।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাজীবুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আমাকে পাঁচবার প্রতিবেদন বদলাতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা চেয়েছে লেখা হোক যে ‘পাথর নিক্ষেপে’ মৃত্যু হয়েছে, যদিও তিনি পুলিশের গুলিতেই নিহত হয়েছেন।
সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তার পরিবারকে ঢাকায় বিমানে পাঠানো হয়েছিল হাসিনার সঙ্গে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে মোট ৪০টি পরিবার জড়ো হয়েছিল- তাদের সবারই আত্মীয়স্বজন বিক্ষোভে নিহত হয়েছিল।
নিহত সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আমাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। না গেলে হয়তো আরও খারাপ কিছু ঘটতো। ক্যামেরায় ঘটনাটি রেকর্ড করার সঙ্গে সঙ্গে হাসিনা প্রতিটি পরিবারকে টাকা তুলে দেন। তিনি সাঈদের বোন সুমি খাতুনকে বলেন, আমরা তোমার পরিবারকে ন্যায়বিচার প্রদান করবো। সুমি প্রধানমন্ত্রীকে উত্তর দেন, ভিডিওতে দেখানো হয়েছে যে, পুলিশ তাকে গুলি করেছে। এখানে তদন্ত করার কী আছে? এখানে আসাটা ভুল ছিল।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেন, হাসিনা কখনো ‘মারাত্মক অস্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেননি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে অনুমোদন দেননি। তিনি বলেন, এই (হাসিনার ফোনের) রেকর্ডিংটি কোনো নির্দিষ্ট অংশ বেছে নেওয়া, বিকৃত বা উভয়ই।
তবে আবু সাঈদকে হত্যার বিষয়টি প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ওই সময়ের লাইভ ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রমাণ দেয়া হয়েছে। সেখানে শিক্ষানবীশ সাংবাদিক তৌহিদুল হক সিয়ামের ভিডিও ফুটেজ ও বর্ণনায় এই হত্যার প্রমাণ মেলে। তার ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ-শিক্ষার্থী মুখোমুখি। শুরু থেকেই আবু সাঈদ পুলিশের টার্গেটে ছিলো। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় পাঁচ জন পুলিশ আবু সাঈদের মাথায় আঘাত করে। তখনো আবু সাঈদ ছিলেন নির্লিপ্ত। কারো সাহায্য চাননি। সে সময় তিনি শুট শুট মি বলে দুই হাত আকাশের দিকে প্রসারিত করে।
সাংবাদিক তৌহিদুল হক সিয়াম বলেন, যখন শিক্ষার্থীরা এক নম্বর গেটের কাছে চলে এলে। পুলিশ ছাত্রদের বাধার মুখে ক্যাম্পানের ভেতরে চলে যায়। ১৬ জুলাই যখন আবু সাঈদের ওপর গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন পাশে যিনি ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন উনি বুঝতে পেরে গুলি করতে নিষেধ করেন। ভেতর থেকে ক্যাম্পাসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারি ও পুলিশ মিলে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ইট-পাটেকেল, টিয়ারশেল ও গুলি করতে করতে ক্যাম্পাসের দিকে চলে আসে। পুলিশের বাধার মুখে যখন শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছিলো, আবু সাঈদ তখন ক্যাম্পাসের ১ নম্বর গেটের দিকে আসতে ইন্সপায়র করার জন্য শ্যুট মি শ্যুট পি বলে বুক পেতে দেয়। প্রথম গুলিটা লাগে তার পেটে। ঠিক ওই মুহূর্তে একজন পুলিশ ঠিক তার কাছে এসে বুক বরাবর গুলি করে। পর পর দুটি গুলি তার বুকে লাগে।