ডিজিটাল ক্রাকডাউনের বিচার কবে? ‘আড়িপাতা’ ঠেকাবে কে?

১৮ জুলাই, ২০২৫  
১৮ জুলাই, ২০২৫  
ডিজিটাল ক্রাকডাউনের বিচার কবে? ‘আড়িপাতা’ ঠেকাবে কে?

১৬ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ দিয়ে শুরু হলেও ১৮ জুলাই ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ করে দিয়ে কানেক্টিভিটির ইতিহাসে রচিত হয় এক কালো অধ্যায়। গত বছরের এ দিন থেকেই মুক্তির আগ পর্যন্ত ডিজিটাল ব্লাকআউটে যায় বাংলাদেশ। ২৫ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত চলে ইন্টারনেটের লুকোচুরি। ৩ আগষ্ট ফের মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করার পর সেই সংযোগ ফেরে ৫ আগষ্ট দুপুরে।  

সোশ্যাল মিডিয়ায় হেনস্তা, রাষ্ট্রীয় প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে এবং কালো আইনে কন্ঠরোধের সব কৌশল ব্যবহার করেও প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিকের ক্ষমতায়নের এই প্রকৌশলকেই গলা টিপে ধরা হয়। নানা উদ্যোগে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রমাণ অবশ্য ইতিমধ্যেই মিলেছে। গোপালগঞ্জ ইস্যুতে সোশ্যাল হ্যান্ডেল জুড়ে নানা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ালেও ইন্টারনেট বন্ধ হয়নি।  

সেই অর্থে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউনের এক বছর আজ। যে সরকার সেবাটিকে ‘জরুরী সেবা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলো বেসামাল হয়ে সেই আওয়ামী লীগ সরকারের এই ‘ক্রাকডাউন’ ইতিমধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দায়িত্ব নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই ঘটনার তদন্তের ঘোষণা দিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। গত বছরের ১১ আগস্ট  সেই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু ১০ মাস পড়েও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।

অবশ্য সেই দুঃসহ স্মৃতির দিনে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। ৫ দিনের জন্য সব মোবাইল অপারেটর গ্রাহকদের জন্য ১ জিবি ফ্রি ইন্টারনেট দিচ্ছে। কিন্তু কী কাজে এই ফ্রি ইন্টারনেট গ্রাহক ব্যবহার করবেন- সেই প্রশ্ন এখনো রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দগদগে ঘায়ের মতো। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন জুয়া (বেটিং) মচ্ছবে রূপ নিচ্ছে। পর্ণোগ্রাফি, পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো গেইমের সহিংসতা কিশোর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ‘কিশোর গ্যাং’ অ্যাকশনে তার প্রকট রূপ আমরা মাঝে মধ্যেই দেখছি।   
 
সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্সে ইন্টারনেটে বাধা সৃষ্টিকে শাস্তি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও এখনো আড়িপাতা বন্ধের কোনো সুরহা হয়নি। উপগ্রহ ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা চালু করার পর নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে পর্ণোগ্রাফি ও সাইবার দুবৃত্তপনা বেড়ে যাওয়ার ঘটনায়। এমন পরিস্থিতিতে মৌলিক অধিকার ঘোষণার পাশাপাশি এর সুরক্ষা, প্রোপাগাণ্ডা মোকাবেলা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়নের সময় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ৫দিন এবং মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকে ১০ দিন। এতে কেবল ই-কমার্স খাতেই ক্ষতি হয় ২ হাজার টাকার বেশি আইএসপিএবি। ওই সময় ইন্টারনেট বন্ধে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় ৩০ শতাংশ জনবল চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছিলো বেসিস। তবে বিস্ময়ের হলেও সেসময় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি’র আর্থিক ক্ষতি’র কোনো হিসাব তখন প্রকাশ করা হয়নি। তবে ওই সময়ের ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেট গ্রাহক অনুযায়ী ক্ষতির হিসাব করলে দেখা দেয়, শুধু বিলের ক্ষেত্রে দেড় শ’ কোটি টাকা হারিয়েছে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী।  

ইন্টারনেট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে প্রতি দিনের ক্ষতি পরিমাণ ছিলো ৩৫ লাখ ডলার। সেই হিসেবে ওই দিনগুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার কম নয়। তবে আর্থিক ক্ষতির চেয়েও প্রকৃত ক্ষতি অনেক বেশি। 

তারপরও এ নিয়ে দীর্ঘ দিনেও বিচার না হওয়া এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করতে সরকারের দৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি রাজনীতিক-প্রযুক্তিবিদ ও আইন বিশেষজ্ঞদের টেকনোক্র্যাট ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, এরই মধ্যে উপগ্রহ ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা দেশে চালু নতুন আশার আলো জ্বাললেও বেধে দেয়া ৯০ দিনের মধ্যে ৬০ দিনেও বাংলাদেশ গেটওয়ে স্থাপন না করায় দেশের মধ্যে অনলাইন জুয়া, পর্ণোগ্রাফি ও ক্ষতিকর গেমিংয়ে হুমকীর মুখে পড়ছে সম্ভাবনাময় তারুণ্য।আবার ডাউনলোড গতির চেয়ে আপলোড গতি কম থাকায় (১৫ থেকে ২০ এমবিপিএস) ফ্রিল্যান্সারদের কাজের প্রকৃত সুবিধা প্রাপ্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যেমনটা ধাক্কা খেতে হচ্ছে চলমান বর্ষায় মেঘের লুকোচুরিতে। কেননা মেঘ হলেও নেটওয়ার্ক ডিজরাপশনে পড়ছেন ব্যবহারকারী। পাচ্ছেন এরর বার্তা। এর ওপর জনারণ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আরো একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন এসেছে, বিটিআরসি’র কাছে থেকে ১০ হাজার সংযোগের অনুমতি নিয়েছে স্টারলিংক। কিটসহ দাম ৫৬ হাজার। তাহলে ১০ হাজার গুণ ৫৬ হাজার ডলার ধরে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার দেশের বাইরে চলে গেছে। এই ডলার থেকে সরকার কি কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স পেয়েছে?  

আর্থিক এসব বিষয় পাশে রেখেও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন আর্থিক ডিজিটাল ক্রাকডাউনের বিচার কবে? ‘আড়িপাতা’ ঠেকাবে কে?