ইলন মাস্ক, স্টারলিংক ও বাংলাদেশ

দুনিয়ায় আনাচে কানাচে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের মাধ্যমে হাই স্পিড ইন্টারনেট সেবা দিতে স্টারলিংক বানিয়েছেন ইলন মাস্ক। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষ পথে ছোট ছোট লো আর্থ অরবিট ( LEO) স্যাটেলাইট দিয়ে ফুট প্রিন্ট তৈরি করেছে। পৃথিবীর যে সব অঞ্চলে মোবাইল বা অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছাতে পারেনি বা সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ হয়নি; সেই সব অঞ্চলে স্টারলিংক দিয়ে খুব সহজেই দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা দেয়া যায়। লক্ষ্য অনুযায়ী, তারা যত বেশী দেশে যত বেশী গ্রাহককে সেবা দিতে পারবে তাদের রাজস্ব তত বেশী বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগ উঠে আসবে।
২০১৬ সালের দিকে ইলন মাস্কের আগে গুগলের বিনিয়োগে SES Network O3b( Other 3 Billion) নামের আরও একটি কোম্পানি প্রায় ১২-১৩টি লিও স্যাটেলাইট উন্মোচন করেছিল। তাদের ট্যাগ লাইন ছিল “Fiber in the Sky”। পৃথিবীর প্রায় তিন বিলিয়ন জনসংখ্যা অপটিক্যাল ফাইবার ব্রডব্যান্ড সংযোগের আওতার বাইরে থাকায় তাদেরকে সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই কোম্পানি শুরু হয়েছিল। তারা প্যাসিফিক ও আটলান্টিক মহাসাগর অঞ্চলের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে টার্গেট করে ব্যবসা শুরু করেছিল। কিন্ত তাদের কার্যক্রম বেশি দিন চোখে পড়েনি ।
স্টারলিংক বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু টেলিযোগাযোগ খাত একটি নিয়ন্ত্রিত খাত হওয়ায় প্রত্যেকটা দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়েই তাদের সেবা চালু করতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য এখন পর্যন্ত শ্রীলংকা অনুমোদন দিয়েছে। নেপাল প্রায় দিবে দিবে করছে। ভারত ও পাকিস্তানে বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো আইনি বাধা ( Lawful Interception) সংক্রান্ত কোন ইস্যু । শ্রীলংকা যেহেতু ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র, তাই তাদের জন্য সহজলভ্য ও উপযুক্ত প্রযুক্তি হবে স্যাটেলাইট।
স্টারলিংক এর ওয়বসাইট জানাচ্ছে, বাসাবাড়ির জন্য বর্তমানে স্টারলিংকের মাসিক আনলিমিটেড স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ ৭৫ ডলার বা প্রায় ৯০০০টাকা এবং স্যাটেলাইট ডিস (কিট) এর জন্য এককালীন প্রায় ৪৫,০০০ টাকা। বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র ৯ ডলার দিয়ে প্রি-অর্ডার করা যাচ্ছে। কিন্তু মাসিক চার্জের ব্যপারে স্পষ্ট কিছু নাই। রেগুলেটরি অনুমোদন সাপেক্ষে ২০২৫ সালের প্রথম দিক থেকে পাওয়া যাবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় বাজারে প্রবেশের জন্য তারা বিশেষ মূল্য ছাড় দিয়ে প্যাকেজ তৈরী করছে। কয়েক মাস আগে একটা নিউজে দেখেছিলাম নাইজেরিয়ান রেগুলেটর স্টারলিংকের সেবার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণ- স্টারলিংক অনুমোদন ছাড়াই সেখানে ২৫ ডলারের ( প্রায় ৩০০০ টাকা) মাসিক আনলিমিটেড চার্জ থেকে প্রায় ৪৮ ডলারে (৫৭৬০ টাকা) বৃদ্ধি করে ফেলেছে।
ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে মাসিক ৫০০ টাকা দিয়ে সর্বনিম্ন প্যাকেজের ফিক্সড ব্রডব্যান্ড সেবা দেয়াই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটর খরচ বাসাবাড়িতে কতটা কমাতে পারবে আর সেই দাম কতটুকু ফিজিবল হবে তা দেখার বিষয়। তবে কর্পোরেট মার্কেটে দূরবর্তী অঞ্চলে যেখানে ফাইবার নেই, সেখানে খরচ বেশী হলেও তারা অবশ্যই স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিবে।
ইলনমাস্ক বর্তমানে শুধুমাত্র পৃথিবীর শীর্ষ ধনী (৪০২ বিলিয়ন ডলার) ব্যক্তিই নন, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের খুবই কাছের একজন মানুষ। সরকারের খরচ কমিয়ে ওয়াশিংটনের কাজকর্মে গতি আনতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পে তাকে ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি ( DOGE) বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। অবশ্য ইলন মাস্ক একজন সফল মেগা উদ্যোক্তা। তারা অনেক উদ্যোগের মধ্যে স্টারলিংক ছাড়াও পেপল, টেসলা, স্পেসএক্স, এক্স, দি বোরিং কোম্পানির নাম এক দমে বলে ফেলা যায়।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ইলন মাস্কের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করেছেন। বর্তমান সরকারের উচ্চ পদস্থ অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রধান এ রকম একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সংগে মিটিং করেছেন যা খুবই প্রশংসনীয় ।বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালু করা, গ্রামীন টেলিকমের পল্লীফোন, মাইক্রো ক্রেডিট, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি নিয়ে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এই নিউজ নিয়ে বাংলাদেশের অনেকেই অনেক উচ্ছ্বসিত ও উত্তেজিত। আমি একটুও হতে পারছি না। স্টারলিংক বিনিয়োগ করে বসে আছে। রাজস্ব বাড়িয়ে বিনিয়োগ তোলার জন্য নতুন নতুন দেশে সেবা চালু করে গ্রাহক বৃদ্ধি করতে হবে। স্টারলিংক-কে আগামীকাল অনুমোদন দিলে অল্প দিনের মধ্যেই সেবা দিতে পারবে। ইলন মাস্ক তার নিজের স্বার্থে শুধু স্টারলিংক নিয়েই কথা বলতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক ।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে আরও একটি নিউজ হেডলাইন দেখা যায়, মোদির সাথে ইলন মাস্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের তিন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাক্ষাৎ। ধান্দাটা বুঝছেনতো! ভারতেও স্টার লিংকের অনুমোদন চায়। ওরা ভাই ব্যবসার জন্যই সবকিছু করে। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিলো অন্য জায়গায়। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা কেন শুধুমাত্র স্টারলিংক নিয়ে ইলন মাস্কের সাথে কথা বলবেন। ইলন মাস্ককে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে তিনি কি ভাবছেন।
তিনি কি বাংলাদেশে কিছু বিনিয়োগ করতে চান? উনি কি বাংলাদেশে কোন ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট করতে চান? বাংলাদেশে কি কোন সফটওয়্যার কোম্পানি করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে তার কোন বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং ( বিপিও) করতে চান? বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক ইয়ং, ট্যালেন্টেড, কর্মঠ জনশক্তি আছে। তাদেরকে সঠিক ট্রেনিং দিলে অনেক সস্তায় দক্ষতার সাথে ইলন মাস্কের অনেক কাজ করে দিতে পারবে। বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য ইলন মাস্ক কি পলিসি সাপোর্ট চান? ইত্যাদি। এইসব ব্যাপারে কোন আলোচনা হয়ে থাকলে তা উন্মুক্ত হওয়া দরকার। এতে উদ্যোগটি অন্তর্ভূক্তিমূলক ও টেকসই হবে। আর ইলন মাস্কের মত কাউকে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী হিসাবে আনতে পারলে তার পেছনে পেছনে লাইন ধরে অনেক গ্লোবাল কোম্পানিও চলে আসার সম্ভাবনা তৈরী হবে।
লেখক: সিইও, ইন্টারক্লাউড লিমিটেড