ইমদাদুল হক
কিভাবে পরিত্রাণ মিলবে ফ্রি ফায়ার, পাবজি ও টিকটক সঙ্কট থেকে? লেখাটি প্রকাশের পর কেউ কেউ ‘নিষিদ্ধ’ করার পক্ষেই অবস্থান থেকে নিজেদের ভাবনাকে আরেকটু টিউনিং করতে শুরু করেছেন। তাদের জন্যই আবারো একই প্রসঙ্গে আজকের লেখাটি।
ক’দিন ধরে দেশে দুইটি গেম নিয়ে চারদিকে চলছে ‘নিষদ্ধ’ মাতম। যা এর সঙ্গে অপরিচিতদেরকেও যেমনটা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে; তেমনি কৌতুহলের জন্ম দিয়ে সেই পথে নিয়ে যাওয়ার পথে মোটেই কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারছে না।
তাই আমি মনে করি, নিষিদ্ধ রোল তুলে নয় প্রযুক্তি দিয়েই এই সমস্যা মোকাবেলা করা যেতে পারে। আর সমস্যাটি যে শুধু বাংলাদেশের নয় একটি প্রজন্মের সে বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সুশীল বুদ্ধিজীবি সমাজ এগিয়ে আসবেন।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশে তাদের সার্ভার বসানো বাধ্যতামূলক করে গেমটি ব্যবহারের সময় সীমা প্যারেন্টিং কন্ট্রোলের অধীনে নিয়ে আসা যেতে পারে।
সমস্যাটিকে সম্ভাব্য মানবীয় সঙ্কট বিবেচনায় নিয়ে অংশীজনদের অংশগ্রহণে একটি ক্রসবর্ডার গেমিং নীতিমালা করা যেতে পারে। এই পরামর্শ কমিটিতে গেমারদেরও অন্তর্ভূক্ত করে তাদের কথাও শোনা দরকার। তারপর একটি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। তা না হলে এটা আরেক গন্ধম হিসেবে রূপ নিবে।
গেম তৈরি ও খেলার নিয়মের সঙ্গে বাস্তবতার মিল রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন ও স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী মহাদেশ ভিত্তিক গেমিং সংস্করণ তৈরিতে নির্মাতাদের একটি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। সিনেমাগুলো যেভাবে সেন্সর করা হয় এক্ষেত্রেও সেই বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এই দায় প্রতিপালনে গেম ইঞ্জিন থেকে শুরু করে স্টোরগুলোতেও একটা নির্দেশনা পাঠিয়ে দিতে হবে। এই নির্দেশনা দেশ/মহাদেশ ভিক্তিক হলে পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।
এই সঙ্কেটকালকে সম্ভবনার সময় হিসেবে বিবেচনা করতে পারে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে স্থানীয় গেম নির্মাতাদের বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে সেরকম গল্প দিয়ে গেম তৈরির বিষয়ে উৎসাহ দিলে সমনের দিনে গেমিং অর্থনীতি থেকেও বাংলাদেশের আয় বাড়বে। গেমের গল্প তৈরির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং সার্বিকভাবে মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সংবেদনশীল গেম তৈরিতে যদি প্রণোদনা দেয়া যায় এবং এর অ্যাভাটার চরিত্রগুলোর নকশায় যদি দেশীয়/মহাদেশী ঐতিহ্যকে লালন করারা সুযোগ রাখা হয়, তবে অবশ্যই বাংলাদেশের গেমই একসময় বিশ্বজয় করবে। তখন এই নিষিদ্ধ আন্দোলনে মেধা-মননকে ব্যস্ত না রেখে সৃজনশীলতার পথকে আরো প্রশস্ত করবে।
অনেকেই হয়তো বলবেন, সম্প্রতি নেপালে পাবজি নিষিদ্ধ করে দেশটির আদালত। একই কারণে ভারতের গুজরাটেও এ গেম খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এমনকি গেমটি খেলার জন্য কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। বাংলাদেশেও পাবজি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল, পরে আবার চালু করা হয়। তবে এখন সমস্যা কোথায়?
এই প্রশ্নের জবাবে বিনীত ভাবে বলতে চাই, ভারত সম্প্রতি পাবজির বিকল্প গেম ‘ফৌজ’ তৈরি করছে সেটাও মাথায় রাখতে হবে। তবে কারো অনুকরণ না করে এক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ও বিজয়ী জাতি হিসেবে আমাদেরকে নেতৃত্বের আসনে আসতে হলে এই মহূর্তে ক্রসবর্ডার গেমিং নীতিমালা তৈরি ও প্রতিপালন এবং নিজেদের গেমিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার বিষয়ে আরো সক্রিয় হতে হবে। তা না হলে আজ একটি তো কাল আরেকটি গেম নিষিদ্ধের দাবি চলতেই থাকবে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান মিলবে না।
ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়ত ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরণের হরমোন নি:সরণ হয়। এতে শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। সব কিছুর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া কারো সঙ্গে মিশতে না পারা, ঘুম, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম তো রয়েছেই। এসমন সব কিছু বিবেচনায় এনেই এই আসক্তিকে এরইমধ্যে ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিষয়টিকে নজরে নিয়ে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়েও ভাবতে পারেন আমাদের নীতি নির্ধারকেরা। আর ভাবনার অগ্রভাগে ‘নিষিদ্ধ’ আন্দলন উস্কে না দিয়ে গেমারদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার কৌশলটাই এখন বেশি জরুরী।
কেননা যত বেশি নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারিত হবে ততটাই গেমার-অভিভাবকদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হবে। আর অন্দর মহলের আলাপকে বৈঠকখানার বাইরে গিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে শেষতক খুব বেশি লাভবান হওয়ার উপায় নেই। কেননা, যারা খেলছে তারা ঘরের সন্তান। আমাদেরই কেউ। তাকে সম্মোহন করার ক্ষমতা অর্জন করা এবং সেই পরিবেশটা তৈরি করাটাই এখন সবার আগে জরুরী। সেজন্য উদ্ভাবনী বিকল্প ছাড়া কোনো অবকাশ নেই। নিষিদ্ধতা, কড়া আইন, হাতকড়া অথবা অস্ত্রপচারে কিশোর মনের বিকাশ হবে না। পারিবারিক পরিমন্ডলে ‘ডিজিটাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ লালনের জন্য একটা মহাপরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। তবে তার আগে আসক্তদের ফিরিয়ে আনার চিকিৎসাটাই জরুরী। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ বিকাশের পথেই হাঁটতে হবে আমাদের।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিবাংলা