ইমদাদুল হক
অ্যাঙ্গরি বার্ড, টেম্পল রান, ক্যান্ডি ক্রাশ এখন মামুলি। অনলাইনে গেমে মারদাঙ্গা পর্যায়ে চলে এসেছে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি। সহিংসতায় পূর্ণ গেম দুটি এখন দখল করে নিচ্ছে কিশোর মনের সব মনোযোগ। আর এসঙ্গে ব্যঙ্গ, অনুকরণ এমনকি জাল ভিডিও তৈরির মস্করায় কেবল কিশোর-তরুণ নয় পরিণত বয়সীদেরও গ্রাস করে ফেলছে ‘টিকটক’।
এই তিনের আবাহান জেড প্রজন্মকে একটু একটু করে জড়িয়ে ধরছে ডিজিটাল আসক্তিতে। রেখে যাচ্ছে নির্মমতার ছাপ। বাড়ছে অপরাধ প্রবনতা। তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যা।
গেম খেলার জন্য মোবাইলের ডাটা কেনার টাকা না পেয়ে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে গত ২১ মে চাঁদপুরে মামুন আত্মহত্যা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকাঁদানো ব্লু-হোয়েলের কথা। উত্তরারা কিশোর গ্যাংয়ের টিকটক কাণ্ডর রেশ কাটতে না কাটতেই টিকটক ভিডিও তৈরির ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ভারতে পাচার করা হচ্ছে। এমন অপকর্মে জড়িত হওয়ায় শুক্রবার (২৮ মে) ভারতের বেঙ্গালুরুতে গ্রেফতারের পর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বাংলদেশের রিফাদুল ওরফে টিকটক হৃদয়।
সব মিলিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার শেষ নেই। তারপরও সহসাই বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব অ্যাপ ও গেমগুলি। এই সঙ্কট আসলে নিষদ্ধ করার মধ্য দিয়ে কাটবে না। সঙ্কট কাটাতে অংশীজনদের সম্মিলিত প্রয়াসের বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে দায়টা নির্মাতাদেরই বেশি নিতে হবে।
কেননা ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর দেশে একবার পাবজি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিলো। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালে বন্ধ করা হয় গেমটি। ভারত এখন নিজেই এ ধরনের গেম বানানো উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবাজ গেমগুলো থেকে নিস্তার মিলছে না প্রস্পূটিত প্রজন্মের। যেমনটা টিকটক কর্তৃপক্ষ আপত্তিকর ভিডিও মনিটর করবে প্রতিশ্রুতি দেয়ায় বাংলাদেশ সরকার এটি বন্ধ করতে গিয়ে করেনি। কিন্তু এখন আমরা কী দেখছি? এই অ্যাপটি বহাল তবিয়তে চলছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে।
এবার স্বাক্ষ্য-প্রমাণসহ পুরোনো দুই অনলাইন দুষ্টচক্রের সঙ্গে কাঠগড়ায় উঠে এসেছে গেরিনা ফ্রি ফায়ার (ফ্রি ফায়ার ব্যাটলগ্রাউন্ডস বা ফ্রি ফায়ার নামেও পরিচিত) একটি ব্যাটল রয়্যাল গেম। এসব গেম ও অ্যাপগুলো বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয়তায় শীর্ষ হওয়ায় এর কোনো কূল-কিনারা মিলছে না সহজেই। আর দিন যত গড়াবে বরুদের গন্ধ যেন ততটাই ছড়িয়ে পড়বে আত্মঘাতি এলএসডি মাদকের মতো।
খবরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে গেমগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সুপারিশ করা হয়েছে । বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আলোচনাতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো ব্যবহারে ভিপিএনসহ নানা বিকল্প উপায় থাকায় এবার আর হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। পরিপক্ক এই ভাবনাটির প্রতি শতভাগ সম্মান জানাই। কেননা কিশোর মনে নিষিদ্ধের আকর্ষণ আরো বেপরোয়া। তবে পরিত্রাণের পথ বের করতে হবে আমাদেরকেই।
যতদূর জেনেছি, অভিযুক্ত দুটি গেম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করেছে স্বীকার করেই টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এগুলো হঠাৎ করে বন্ধ করতে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। তাই ধীরে সুস্থে বিকল্প পদ্ধতিতে গেম দুটি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে। এক্ষেত্রে ভিপিএনসহ বিকল্প উপায়গুলো বন্ধের বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন সংশ্লিষ্টারা।
কর্তৃপক্ষের এই ভাবনাটা অত্যন্ত যৌক্তিক। আর তাই, কেবল সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি পারিবারিক ভাবেও এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। টিনেজার গ্রুপ লিডারদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এই সঙ্কটে যুক্ত হতে হবে আমাদের তারকাদেরকেও। তা না হলে এই সঙ্কট করোনা মহামারির মতোই ছড়িয়ে যেতে পারে।
এক্ষেত্রে আমরা আস্থা রাখতে চাই দেশের গেমিং কোম্পানিগুলোর ওপর। ক্রাউডসোসিংয়ের মাধ্যমে হলেও এমন একটি গেম তরুণদের উপহার দিক যেই গেমটি কিশোর মনকে সহিংসতা থেকে নিরস্ত করবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠোপোষকতায় এমন একটি মেগা প্রকল্প নেয়া যেতে পারে আইসিটি বিভাগ থেকে, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যেমে। একইসঙ্গে টেলিকম মন্ত্রণালায় দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত সকল মোবাইল ফোনেই এই গেমটি প্রি-ইনস্টলে বাধ্য করতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতির গেম বিপ্লব দিয়েই টগবগে কিশোরের রক্তের তেজকে ভারসাম্যাবস্থায় রাখতে হবে।
কিশোর প্রজন্মকে সাইবার জগতে সুস্থ্য ও মানবিক বিকাশে গেম তৈরির ক্ষেত্রেও ফ্যান্টাসিজম ব্যবহারে বৈশ্বিকভাবে একটি নীতিমালা দাঁড় করাতে হবে। শুধু প্যাকেটের গায়ে সতর্ক বার্তা দেয়াটাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় হবে না। এক্ষেত্রে কল্পনার বিষয় যুক্ত করলেও গেমে খেলোয়াড়কে বাস্তবতার আইন ও অনুশাসনের মধ্য দিয়েই যুদ্ধকালীন গ্রহণযোগ্য আচরণের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এই যেমন যুদ্ধের গেমে‘নারী-শিশু’ যখম করা থেকে নিরস্ত থাকার মতো বেলো বা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে গেমের পয়েন্ট নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে বাস্তবের যুদ্ধ থেকেও ভার্চুয়াল এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা গোটা বিশ্বকেই অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিবাংলা