টানা ২০ ঘন্টা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করেও ক্লান্ত হয়নি তারা। উদ্ভাবন করেছে স্মার্ট রোড সেইফটি বিস্ট। সাতটি ডিভাইসের সমন্বিত এআই ভিত্তিক ভিহ্যাকেল সেফটি গার্ড ও অ্যাপ্লিকেশনটি বিশ্বে অনন্য। সেই উদ্ভাবন দিয়েই এবার কেশর ফুলিয়ে ‘নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ’ বাজিমাৎ করতে যাচ্ছে কিশোর উদ্ভাবকেরা। তিন ধাপ জয়ের পর ছোটদের এই বড় বিজয়ের চূড়ায় উঠেছে ‘নট এ বোরিং টিম’। এবার অপেক্ষা লালা-সবুজের পতাকা ওড়ানোর।
ছোটদের হাতে বড় বিজয়
ওদের বয়স ১৩-১৮ এর মধ্যে। কিশোর মন হতবিহ্বল স্কুল যাতায়াতের পথে নিত্য সড়ক দুর্ঘটনা দেখে। সেই সড়ক দুর্ঘনায় প্রাণ বাঁচাতে নতুন কিছু উদ্ভাবনে জোট বাঁধে পাঁচ কিশোর। রাজধানী নয় ওদের বাস দেশের উত্তরাঞ্চলে। ভাবনার শুরুটা আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ ত্ব-সীন ইলাহীর এবং তার টিমমেট দের মাথা থেকে। স্বপ্নপূরণের সাথী হন নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয়ের মাহদী বিন ফেরদৌস, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের মোঃ নুর আহমাদ, নওগাঁর নাজিপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নাদিম শাহরিয়ার অপূর্ব এবং নরসিংদীর ছেলে, রাজধানীর ধানমন্ডির লরেটো স্কুলের এ লেভেল পড়ুয়া মোঃ সানজিম হোসেন। তাদের উদ্ভাবনে সহযোগী ছিলেন ডুয়েটের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগের স্নাতকত্তর শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান।
নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ
উদ্ভাবনী ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ ‘নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ’। প্রতিযোগিতায় মহাকাশ, সাইবার সুরক্ষা প্রযুক্তি, আসরের শক্তি ও পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চার ক্যাটাগরিতে টেকসই উদ্ভাবনী প্রকল্পের ব্যবসায়িক মডেল উপস্থাপন করতে হয় প্রতিযোগীদের। চারটি রাউন্ডে চলে এই চ্যালেঞ্জে অংশ নেয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ উদ্ভাবকেরা। ভার্চুয়াল প্রতিযোগিতায় অতিক্রম করতে হয় তিনটি ধাপ। এরপরই টিকেট মিলবে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টন শহরে জনসন স্পেসের। এদের মধ্যে যারা নায়াগ্রার চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পারবে তারা প্রত্যেকেই পাবেন মিনলো কলেজে অধ্যয়নে ৮০ হাজার, লুইস অ্যান্ড ক্লার্ক কলেজে ৬০ হাজার এবং ক্লার্কস্টোন উইনিভার্সিটিতে অধ্যয়নের ৬০ হাজার ডলারের শিক্ষাবৃত্তি। রানার্সআপ দলের সদস্যরা ৫ লাখ ডলার নগদ পুরস্কার। এবারের নায়াগ্রা চ্যালেঞ্জে (নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ২০২৩-২৪) বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশের ৩৪০০ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ১০ম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ ‘নট এ বোরিং টিম’। এর আগে ২০১৫ সালে একটি দল প্রথমবারের মতো এ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিলো। নয় বছর পর ফের তৃতীয় ধাপ পার করেছে বাংলাদেশের দলটি। বর্তমানে অল্টারনেটিভ ফাইনালিস্ট হিসেবে অবস্থান করছে দলের সদস্যরা। এখন আগামী ২৩ থেকে ২৬ জুন নাসার ঐতিহাসিক জনসন স্পেস সেন্টার এবং স্পেস সেন্টার হিউস্টনের ককপিটে ওঠার প্রহর গুণছে তারা।
মেসেঞ্জারে জন্ম ‘নট এ বোরিং টিম’
বিভিন্ন সময়ে দেশে অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াড ও রোবটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো এই কিশোরেরা। সেসব প্রতিযোগিতায় পরিচয়ের সূত্র ধরে গেলো বছরে সেপ্টেম্বরে মেসেঞ্জারে দল গঠন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ ত্ব-সীন ইলাহী। এরপর সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে নভেম্বরে ‘নাসা কনরাড চ্যালেঞ্জ’- এ আবেদন করে ‘নট এ বোরিং টিম’।
দলের নাম নট এ বোরিং টিম কী করে হলো তা জানলেও থমকে দাঁড়াবেন পাঠক। টিম মেম্বারদের মধ্যে ত্বসীন ও মাহদী টানা ১৯ ঘন্টার বেশি কাজ করেছে। পরিশ্রমের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, তাদের টিম মেম্বাররা কয়েক রাত ঘুমায়নি। অধিনায়ক ত্বসীন ইলাহি সাবমিশন ডেট লাইনে শেষ ৭২ ঘন্টায়, মাত্র ১০ ঘন্টা ঘুমিয়েছে। বাকি সময় শুধু কাজই করে গেছে। মাহাদী, নাদিম, সনজীব সবাই একযোগে কাজ করতে থাকে। নূর ওয়েবসাইট ডিজাইন করে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপ করে। মাহাদী বিভিন্ন বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়। নাদিম হার্ডওয়ার দেখতে থাকে এবং সনজীব বিভিন্ন রিসার্চ পেপার পড়তে থাকে। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি সামনে আসতে থাকে। তবে হাল ছেড়ে দেয়নি। এসএসসি পরীক্ষার তখন ২ মাস বাকি। দলনেতা সহ তিনজনই চলতি এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রতিযোগিতায় নেমে নিয়মিত পড়াশুনা শিকেয় উঠেছ। দিন রাত এক করে অবশেষ সময়ের মধ্যে কাজ করে সাবমিট করে তারা। এর মধ্যে খুউবই ভয় পেয়ে যান ত্বহা। কারণ তার গণিত পরীক্ষার আগের দিন রেজাল্ট। ফলাফল বলতে গিয়ে চিক চিক করে ওঠে ওর চিবুক- ‘রেজাল্ট আসার পর নিজ চোখে বিশ্বাস করতে পারনি যে আমরা গোটা বিশ্বের সবাইকে হারিয়ে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছি’।
ত্বসীনের নেতৃত্বে মহদী, নাদিম, সুনজিম, নূর সম্মিলিতভাবে শুরু করে নাসা জয়ের পরিকল্পনা। চলতি বছরের জানুয়ারির ১৩ তারিখে প্রকল্প সাবমিশন করে তারা। প্রকল্প পরিকল্পনা গৃহীত হলে শুরু হয় পরিবেশের মানবিক বিপর্যয় এবং শক্তি সংরক্ষণ মিশন- ‘স্মার্ট রোড সেফটি বিস্ট’ ডিভাইস ও অ্যাপ্লিকেশন প্রস্তুতের কাজ। সঙ্গে চলে ব্যবসায় মডেল তৈরি। এসময় তারা সহযোগিতা নেয় ডুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর। ডিভাইসের প্রটোটাইপ দেখিয়ে তৃতীয় ধাপও উত্তীর্ণ হয় তারা। তবে পথটা এতোটা মসৃন ছিলো না। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। সবাই নাম, ডিটেইলস দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে। তারপর লীন কেনভাস রাউন্ড। এই রাউন্ড এ জিতাটা অবিশ্বাস্য ছিল। এর মাধ্যমেই গ্লোবাল ফাইনালিস্ট হবার স্বপ্ন বুনে সবার মনে। কাজ চলতে থাকে। ফেইলার আসতেই থাকে। প্রায় ১৫ হাজার টাকার কম্পোনেন্ট পুড়ে যায়। তৎক্ষনাৎ হার্ডওয়্যার ছাড়া এনিমেশন তৈরি করে ফেলে।
চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশকে বিশ্বে তুলে ধরা বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্ত থেকে এতোটুকু বয়সেই অক্লান্ত ছুটে চলা ‘নট এ বোরিং টিম’ দলনেতা ত্বসীন বললেন, প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকাদের মধ্যে টিম হিসেবে আমরা সবচেয়ে কম বয়সের মধ্যে পড়ব। কাজ করতে গিয়ে সুযোগ সুবিধাও হয়তোবা আমরা সবচেয়ে কম পেয়েছি। উন্নত বিশ্বের অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছে। ওদের টেকনোলজি, ওদের মেটেরিয়ালস, তাদের অপর্চুনিটি আমাদের থেকে অনেক বেশি। বাট তাও আমাদের কাছে যা ছিল তাই নিয়ে আমরা কাজ করে গেছি এবং আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ একটা ভালো রেজাল্ট এসেছে।
জীবন ও শক্তি বাঁচাতে স্মার্ট রোড সেইফটি বিস্ট
সাতটি কমপোন্টেন্ট এর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘স্মার্ট রোড সেইফটি বিস্ট’। গাড়ির বিভিন্ন অংশে স্থাপন করা হবে বিশেষ নকশার মাদারবোর্ড, ভাইব্রেটর, রিডার সেন্সর, টেকোমিটার, ক্যামেরা এবং অ্যাকসিডেন্ট ডিটেক্টর। আর চালকের মুখোমুখি থাকবে প্রতিটি কম্পোনেন্টের সংযুক্ত ডিসপ্লে। মাদারবোর্ড ও ডিসপ্লেটি ১০ ইঞ্চির মতো বর্গাকার ও কিছুটা পুরু। বাকি ডিভাইসগুলো ৭-৮ সেমি লম্বা ও ৫-৬ সেন্টিমিটার পুরু। ক্যামেরাটি কাজ করে ওয়েব ক্যামেরার মতো। আর গাড়ির ড্যাশ বোর্ডে লাগানো ডিসপ্লেতে সংযুক্ত আছে ভয়েস সেন্সর যা প্রয়োজনে চালককে সময়ে সময়ে সতর্ক করবে। পাশাপাশি এআই রোবট হিসেবেও আবির্ভূত হবে। অর্থাৎ নিজে চালালেও ড্রাইভারলেস কারের সুবিধা মিলবে স্মার্ট রোড সেইফটি বিস্ট গ্যাজেট গিয়ারে। আবার মোবাইলে এর অ্যাপ ডাউনলোড করে নিলে গাড়ির মালিকও যে কোনো স্থান থেকে গড়ি ও গাড়ির চালককে মনিটর করতে পারবেন। চালকের অসতর্কতা মূলক আচরণ বিশ্লেষণ করে ভুল ধরিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করবে এর এআই বট। পুরো গিয়ারটি শুরুতে ৩০-৩৫ হাজার টাকার মধ্যে হবে বলে জানিয়েছেন খুদে উদ্ভাবকেরা। তাদের ভাষ্য, এই খরচেই অটোনোমাস গাড়ির সুবিধা মিলবে বিদ্যমান গাড়িতে। রোধ করা যাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা।
এমন স্বপ্ন নিয়ে উদ্ভাবক দলনেতা বললেন, রাতদিন এক করে সবাই মিলে কাজ করেছি। টিমের কেউই ব্যবসায় সম্বন্ধে বেশি ধারণা রাখত না। তাই কমার্সের বিষয়গুলো শিখতে গিয়েও আমাদের টাইম লেগে যায়। এরপর আরো বিভিন্ন বড় ভাইয়াদের কাছ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা নেয়া হয়। এখন আমরা স্বপ্ন দেখছি, একদিন নিজেদের প্রযুক্তি স্যাটেলাইট তৈরি করবো। দেশীয় প্রযুক্তিতে স্যাটেলাইট নিজের দেশ থেকে উৎক্ষেপণ করব। চন্দ্র ও মঙ্গল জয় করব।
পুচেকেদের অদম্য দৃঢ়তা দেখে যে কেউই উদ্বেলিত হয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের- পাতাল ফেড়ে নামবো নীচে, উঠবো আবার আকাশ ফুঁড়ে/ বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।