সকল বয়সের জন্য ন্যায়সঙ্গত, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি নিশ্চিতে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার। রবিবার (২৯ মে ২০২২) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনাতয়নে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্যসংঘ দিবস-২০২২ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে এই আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে দেয়া উপস্থাপনায় দেশের বর্তমান টেলিযোগাযোগ খাতের অগ্রগতি তুলে ধরেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে দেশে মোবাইল সংযোগ ব্যবহারকারী ছিল ২ কোটি , যা ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৩৪ লাখে। ২০০৬ সালে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ১৫ লাখ, যা ২০২২ সালের এপ্রিলে এসে দাড়িয়েছে ১২ কোটি ৪২ লাখে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী ১ কোটি ১০ লাখ।
২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্যানুযায়ী দেশে নিবন্ধিত মোবাইল ফিনান্সিয়াল সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬১ লাখ। ২০০৮ সালে দেশে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ছিল ৭.৫ জিবিপিএস যা ২০২২ সালের মে মাসে এসে দাড়িয়েছে ৩,৮৫০ জিবিপিএস। ২০০৮ সালে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের মূল্য ছিল ২৭ হাজার টাকা যা ২০২১ সালের জুন মাসে এসে দাড়িয়েছে ২৮৫ টাকায়। ২০০৮ সালে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ছিল ০.১ শতাংশ যা ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এসে দাড়িয়েছে ৪৮ শতাংশে। ২০০৮ সালে দেশে টেলিঘনত্ব ছিল ৩৪.৫ শতাংশ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে যা ১০৫.৮৫ শতাংশ । তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ২জি নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে দেশের শতভাগ মানুষ এবং ৯৮ ভাগ মানুষ ফোরজি নেটওয়ার্ক সুবিধা পাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর ৬টি স্থানে টেলিটক কর্তৃক পরীক্ষামুলকভাবে ফাইভজি সেবা চালু হয়েছে- যোগ করেন শ্যাম সুন্দর শিকদার।
এছাড়া, ফাইভজি গাইডলাইন, ব্রডব্যান্ড পলিসি-২০২২, টেলিকম নেটওয়ার্ক পলিসি-২০২৩, ওটিটি পলিসি ও অ্যাকটিভ শেয়ারিং পলিসি প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ৬৫ বছরের ওপরে জনসংখ্যার হার ৬% , ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মানুষের সংখ্যা ৬৯% এবং ১৪ বছেরর নিচে জনসংখ্যার হার ২৬%। তবে বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা বিশ্বের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের তুলনায় কম ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
এজন্য সরকার, টেলিযোগাযোগ ও ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানকারী, একাডেমিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসম্মত বার্ধক্য এবং উন্নত ডিজিটাল জীবনযাত্রা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান।
দিবসের প্রতিপাদ্যের ওপর আলোকপাত করে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো: রফিকুল মতিন বলেন, দেশে ২০০০ সালে ৬৫ ও তার ওপরের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩.৮৫ শতাংশ, যা ২০২০ সালে এসে দাড়ায় ৫.২৩ শতাংশে। আইটিইউ এর তথ্য অনুযায়ী ২০৫০ সালে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যা হবে দ্বিগুণ। তিনি আরো বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের কর্মক্ষম করে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য অনলাইন পোর্টাল তৈরি করা যেখানে বয়োজ্যেষ্ঠরা পছন্দের কাজ খুঁজে পাবে, ই-কমার্স এর মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারবে এবং অনলাইনে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যাতে স্বত:স্পূর্তভাবে ব্যবহার করতে পারে সে ব্যবস্থাও তৈরি করে দিতে হবে।
প্রতিপাদ্যের ওপর আরো আলোচনা করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো: মাহবুব-উল-আলম। তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্বে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়লেও বাংলাদেশ ২০৩১ সাল পর্যন্ত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ এর সুবিধা ভোগ করবে । তাই কর্মক্ষম মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে এবং প্রবীণদের জন্য প্রযুক্তির সকল সুযোগ সুবিধা যাতে কাজে লাগানো যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযাগাযোগ বিভাগের সচিব জনাব মো: খলিলুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ গ্রহণের সুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করেছ এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় মানুষ ঘরে বসেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সর্ম্পকে যাতে সকলে অবহিত হতে পারে সে বিষয় উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান তিনি।
বিটিআরসি কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকার ওপর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা করেন কমিশনের সিস্টেমস্ এন্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগে: জেনা: মো: নাসিম পারভেজ । এ সময় স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
দিবসটি উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় আর্ন্তজাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এর মহাসচিব হাওলিন ঝাও বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সকলের সম-ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিতকরণ কেবল একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি বিশ্বের সমৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
প্রসঙ্গত, ১৮৬৫ সালের ১৭ মে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা এবং প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ সম্মেলন অনুষ্ঠানের নিদর্শন স্বরূপ ১৯৬৯ সালের ১৭ মে থেকে প্রতিবছর বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস পালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের নভেম্বরে আইটিইউ সম্মেলনে ১৭ মে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য সংঘ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় হয়। ‘বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যসম্মত বার্ধক্যের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি’ (Digital Technologies for Older persons and Healthy Ageing)’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রতিবছরের ন্যায় এবছর বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস-২০২২ উদযাপিত হয়।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে সকালে বিটিআরসি প্রাঙ্গণে আয়োজিত রোড শো’র উদ্ধোধন করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ সময় বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার , ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মোঃ খলিলুর রহমানসহ বিটিআরসি’র উধ্বর্তন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। রোড শো’তে বিটিসিএল, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড, ডাক অধিদপ্তর, মোবাইল অপারেটর, মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এনটিটিএন অপারেটর, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, আইএসপিএবি, আইসিএক্স অপারেটর, আইআইজি অপারেটরসহ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনস্থ দপ্তর ও সংস্থাসমূহ অংশগ্রহণ করে।