মোবাইল অপারেটরদের কর কাঠামো সংস্কারে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটবের যৌক্তিক দাবির পক্ষে রাজস্ববোর্ড-কে চিঠি দেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বিটিআরসি।
বুধাবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁয়ে ‘টেলিকম ট্যাক্স পলিসি এবং ইকোসিস্টেম’ শীর্ষক এই পলিসি ডায়ালগ অনুষ্ঠানে এই আশ্বাস দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (বিআইজিএফ) সঙ্গে যৌথভাবে এই নীতি আলোচনার আয়োজন করে এমটব।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, আমাদের উন্নয়নের জন্য করের দরকার আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটা পলিসি আছে, আমি প্রায় ৩৫ বছর রাজস্ব বোর্ডের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করি। এই পলিসিটা হচ্ছে, যেখান থেকে খুব সহজে কর আদায় করা যায় সেখানেই সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করা হয়। মোবাইল সেক্টরটা সেই সহজে কর আদায় করা যায় আর তাই চাপের মাত্রাটাও বেশি থাকে। কিন্তু এটি বোঝা দরকার, আপনি কোন জায়গায় চাপ দিচ্ছেন। আপনার সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে প্রয়োজনটা আছে সেই জনগোষ্ঠীকে যদি এই চাপের তলায় রাখেন তাহলে জনগোষ্ঠীর বিকাশটাকে বিঘ্নিত করা হবে। আমার মনে হয়, আমরা সেভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি।
ইন্টারনেট ডিজিটাল সভ্যতার বাহন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখনই শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো অতি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ তরুণী ইন্টারনেটের বদৌলতে সফল উদ্যোক্তা হয়েছে।ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ডিজিটাল সংযুক্তির মহাসড়ক তৈরি করতে না পারলে এর দায় আমরা এড়াতে পারবো না। এ লক্ষ্যেই অপারেটরদের এবারের দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো বিটিআরসি সুপারিশ করে পাঠাবে সেখানে টেলিযোগাযোগ বিভাগও সুপারিশ করে রাজস্ব বোর্ডকে পাঠাবে ।
মন্ত্রী মোবাইল ফোনের সেবার মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন কলড্রপের জন্য গ্রাহকদের ক্ষতিপুরণ না দেওয়া গ্রহণ যোগ্য নয় এবং ব্যবসার নীতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ্ হতে পারে না।
বক্তব্যে সময়ের চাহিদা পুরণে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মন্ত্রী।
আর বিশেষ অতিথির বক্তেব্যে ট্যাক্স নিয়ে আপারেটরদের দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো এ আগে শুধু ফরওয়ার্ডিং দিয়ে দেয়া হলেও, এবার সরকার যেনো দাবিগুলো যৌক্তিকভাবে বিবেচনায় নেয় সেজন্য বিটিআরসি হতে সুপারিশসহ তা পাঠানো হবে বলে আশ্বাস দেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাস সুন্দর সিকদার।
তিনি বলেন, “দেশ বিদেশের সকল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যেন সঠিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুসরণ করেই তাদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। টেলিকম খাত শুধু সেবা প্রদানই নয়, দেশের প্রবৃদ্ধিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের ইতিবাচক মনোভাব সবসময়ই বজায় থাকবে। তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই আমরা বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।”
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং বিআইজিএফ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে আরো বক্তব্য রাখেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো: খলিলুর রহমান ও বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান জুয়েল।
এছাড়াও অংশীজনদের মধ্যে এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অবসরপ্রাপ্ত), রবির ভারপ্রাপ্ত সিইও এম রিয়াজ রশিদ।, এরিকসনের কান্ট্রি ম্যানেজার আবদুল সালাম, মীণফোনের ভারপ্রাপ্ত চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার হোসেন সাদাত এবং বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার তৈমুর রহমান বক্তব্য রাখেন।
সভাপতির বক্তব্যে হাসানুল হক ইনু স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং টেলকোখাতের ট্যাক্স যৌক্তিক মাত্রায় নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, টেলকো সেক্টরকে ঘিরে এককোটি মানুষ কর্মরত আছে তিনি ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানান। ডিজিটাল ইকোনোমির জন্য স্মার্ট ফোন সহজলভ্য এবং মোবাইল সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, “তামাক খাতের মতো ক্ষতিকর খাতে টার্নওভার ট্যাক্স যেখানে ১% সেখানে মোবাইল শিল্পে এই ট্যাক্স ২%, যা অবিবেচনাপ্রসূত। এটা ১% এর নিচে নামিয়ে আনা দরকার।”
ইনু আরো বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ওপর যে ভ্যাট রয়েছে তা তুলে দেওয়া দরকার। সরকার এ থেকে কতই বা আয় করে? আধুনিক জীবনে তথ্য সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি এবং মোবাইল খাত হলো এই তথ্য আদান প্রদানসহ সকল ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধানতম বাহন।”
গ্রাহকদের সেবা প্রদানের কথা বিবেচনায় রেখে এই খাতকে আরও কীভাবে জনবান্ধব করা যায় তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. খলিলুর রহমান বলেন, “টেলিকম খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি মনে করি, কিছু কর যৌক্তিক করা দরকার। ট্যাক্স সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে প্রান্তিক গ্রাহকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি এনবিআরের সাথে আলোচনা করব।”
রবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিএফও এম. রিয়াজ রাশিদ বলেন মার্কেটে যত বেশি প্লেয়ার থাকবে অপারেটরদের কাজের দক্ষতা তত বেশি কমবে। আর শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়বে গ্রাহকদের উপর কারণ এতে সেবা প্রদানের ব্যয় বেড়ে যায়। তিনি বিষয়টির উপর নজর দেওয়ার জন্য নীতি নির্ধারকদের মনোযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন।
মূল প্রবন্ধে শাহেদ আলম বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মোবাইল খাতের কর তুলনামূলকভাবে বেশি।” তিনি আরও বলেন, “অপারেটরদের বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন সন্তোষজনক নয়। একদিকে অপারেটরদের গ্রাহকপ্রতি গড় আয় কম অন্যদিকে মোবাইল ভয়েস ও মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। আমরা আরও নতুন ধরনের সাশ্রয়ী সেবা প্রদান করতে চাই। কিন্তু সেবাদাতাদের যদি করের ভারে জর্জরিত করা হয় তাহলে তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যায়। আমরা এই খাতে যৌক্তিক হারে করারোপের দাবি জানাই। আমাদের মনে রাখা দরকার যে দেশের ৪৫ শতাংশ লোক নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও এখনও মোবাইল ব্যবহার করতে পারে না।”
প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় আবদুস সালাম বলেন, “দেশের নেটওয়ার্ক ক্রমশই বিকশিত হচ্ছে, পাশাপাশি নানা রকম সেবাও আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অটোমেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিং ইত্যাদি আমাদের এন্ড-টু-এন্ড সেবা প্রদানকে সহজ করে তুলছে। বাংলাদেশের টেলিকম ইকোসিস্টেমে অনেক বেশি সংখ্যক প্লেয়ার বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন নিয়ন্ত্রক, এমএনও, এনটিটিএন, টাওয়ারকো, গেটওয়ে প্রদানকারী, অ্যাকাডেমিয়া, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি ও আরও অনেকে। এদের যে কোন একটিকেও বাদ দিলে এই খাতের বিকাশ সম্ভব হবে না। ভবিষ্যৎ নেটওয়ার্ক ও সেবার জন্য সরকার এই শিল্পের সবার সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা বাংলাদেশে এই ইকোসিস্টেমের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।”
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান, “সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প বাস্তবায়নে টেলিকম অপারেটররা প্রধানতম সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। করের ভার এবং অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জে থাকা সত্ত্বেও আমরা কোটি কোটি গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছি। আমরা সরকারের ভ্যাকসিন এবং বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পেরে গর্বিত। এখনও অনেক পথ যেতে হবে, কিন্তু আমরা জেনে খুশি যে সরকার লং ডিসট্যান্স টেলিকম নীতি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এটি আমাদের আরও উৎকৃষ্ট সেবা দিতে সাহায্য করবে।”
এছাড়াও গ্রামীণফোনের অ্যাক্টিং সিসিএও হোসেন সাদাত বলেন, “আমরা উচ্চ কর সমস্যা সমাধানের জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রতি বছর বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আমাদের খুব শিগগিরই টেলিকম খাতের ট্যাক্স ব্যবস্থার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের অযৌক্তিক করের বৈষম্য দূর করতে হবে। ভালো ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে করের পরিমাণ কম হওয়া উচিৎ। তৃণমূল স্তরে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য, আমাদের কর যৌক্তিকীকরণ করতে হবে।”