গত তিন বছরে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে মোট চার হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৯২৫টি, ২০১৯ সালে এক হাজার ১৮৯টি ও ২০২০ সালে দায়ের করা মামলার সংখ্যা এক হাজার ১২৮টি। মামলার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এগুলোর ৮৫ ভাগ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এছাড়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মামলা করেছে ৭৬টি, যা মোট দায়েরকৃত মামলার ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
আগামী ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) এই পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপকহারে এই আইন ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ‘দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে সম্পাদক পরিষদ। আইনটি বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা এই আইন দ্বারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।
কঠোর এই আইনের তিন বছর পূর্তিতে এর ব্যবহার সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেছে সিজিএস। এতে বলা হয়েছে, আইনটি চালু হওয়ার পর থেকে সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত দায়ের করা মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ আইনের অধীনে এবং পরবর্তীকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে করা মোট মামলার সংখ্যা চার হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ৯২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৮ সালে, এক হাজার ১৮৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৯ সালে এবং ২০২০ সালে দায়ের করা মামলার সংখ্যা এক হাজার ১২৮টি।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১- এই সময়ের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর অধীনে দেড় হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে এই আইনের ব্যবহার করেছেন এবং এই ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। এসব মামলা চিহ্নিত করে নথিভুক্ত করেছে সিজিএস।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রকল্পটি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’র (এনইডি) অর্থায়নে পরিচালিত। এতে মুখ্য গবেষক হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ।
সিজিএস ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত ৬৬৮টি মামলার বিবরণ চিহ্নিত করেছে। সরকার অনুমোদিত প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তের পরিবার ও তাদের নিকটজন, অভিযুক্তের আইনজীবী, থানা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই মামলাগুলো অত্যন্ত ধীরগতির উল্লেখ করে সিজিএস বলেছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তাছাড়া আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের অনুমোদন সাপেক্ষে আরও ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়। কিন্তু গত তিন বছর ধরে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করার পরেও অভিযুক্ত এখনও হেফাজতে আছে এবং বিচারের আগেই তারা কার্যকরভাবে শাস্তি ভোগ করছেন।
প্রকল্পটির মুখ্য গবেষক ড. আলী রীয়াজ এসব প্রবণতাকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আশঙ্কাজনক বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এই প্রবণতা দেখাচ্ছে যে কীভাবে একটি আইন উদ্ভূত কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসরমান শাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করছে। এই আইনের নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনটি বাতিল করা জরুরি। ’
তার ভাষায়. ‘৬৬৮টি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে ১৪২ জন সাংবাদিক, ৩৫ জন শিক্ষক, ১৯৪ জন রাজনীতিবিদ ও ৬৭ জন শিক্ষার্থী। আমরা ৫৭১ জন মানুষের পেশা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। মোট মামলার প্রায় নয় দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং যাদের পেশা চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ ব্যক্তি সাংবাদিক। ’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘এসব মামলার বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা না হয়ে অন্যদের মাধ্যমে দায়ের করা হয়েছে। প্রায়ই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের নেতাদের পক্ষ নিয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন। অভিযোগকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় চিহ্নিত করার পর দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মামলা করেছে ৭৬টি, যা মোট মামলার ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ’
তিনি আরো জানান, ‘মন্ত্রীদের মানহানির অভিযোগে ৪১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে। বাকি ৩৭টি মামলা দায়ের করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭ জনকে। জামিন পেয়েছেন তিন জন। ’