বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গবেষণা মাঠগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান-১০৫ আবাদে সাফল্য মিলেছে। সবুজ ও খাড়া ডিগ পাতা আর মাঝারি লম্বা ও চিকন ধানের দানার এই ধানটি চাষে এরই মধ্যে বাম্পার ফলন পেতে শুরু করেছেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ, পুষ্টিকর উচ্চফলনশীল এই জাতটি পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০১ সেন্টিমিটার। গড় ফলন হেক্টরে ৭ দশমিক ৬ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় ও অনুকূল পরিবেশে হেক্টর প্রতি ৮ দশমিক ৫ টন পর্যন্ত ফলন দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০২টি (৯৫টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড) উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যার মধ্যে ব্রি-১০৫ হলো স্বল্প পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট সম্পন্ন একটি জাত। এ বছরই প্রথম দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এই ধানের পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে। ফলনও বাম্পার হয়েছে। তাই এই ধান ভবিষ্যতে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
ব্রি ১০৫ একটি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। যার বীজ কৃষক নিজেরাই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবেন। ফলে কৃষককে বীজের জন্য অন্য দেশ বা কোনও কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না- বীজ স্বত্ব কৃষকেরই থাকবে।
ঢাকা বিভগের গোপালগঞ্জ, খুলনা বিভগের নড়াইল ও বাগেরহাট জেলা, ডুমুরিয়া উপজেলায় এই ধান চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণত রক্তের গ্লুকোজ কমাতে ভাতের বদলে রুটি খেতে বলেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়টি মেনে চলা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের জন্য দারুণ একটি সমাধান হতে পারে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের (জিআই) ধান। ডায়াবেটিস ছাড়াও স্থূলতা এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগে ভুগছেন এমন শ্রমজীবী ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্যও উপকারী এ চাল।
মো. আলমগীর হোসেন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) এবং জেনেটিক রিসোর্স ও বীজ বিভাগের প্রধান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই)
বিআরআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ড. খন্দকার মো. ইফতেখারুদ্দৌলা জানিয়েছেন, প্রতি কেজি ধানের গড় উৎপাদন খরচ ২৭ টাকা ১০ পয়সা। একই টাকা খরচ করে কৃষকরা ব্রি ধান ১০৫ চাষ করতে পারবেন।
বোরো মৌসুমে খুলনার ডুমুরিয়ায় চাষ হওয়া এই ধান দূর থকে বোরোর অন্য জাতের মতো দেখালেও বৈশিষ্ট্যগতভাবে এটি দেশে চাষ হওয়া সব প্রজাতির ধান থেকে আলাদা। ডুমুরিয়া উপজেলার টিফনা গ্রামের কৃষক শেখ মঞ্জুর রহমান বলেন, কিছুটা চিকন ও লম্বা জাতের ধানটি বীজ বপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত ১৪৮ দিন সময় লাগে। যেখানেই বোরো মৌসুমের অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যাবে সেখানেই ধানটি চাষ করা যায়। স্থানীয় কৃষকদের এই ধান চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, ধানটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জন্য উপযোগী এবং পরীক্ষামূলক চাষে হেক্টর প্রতি অন্য ধানের চেয়ে এর ফলন বেশি পাওয়া গেছে।
গোপালগঞ্জের চিতলমারীতে কৃষক বিধান চন্দ্র বিশ্বাসের ৩৩ শতক জমিতে ব্রি-১০৫ ধান চাষ হয় বলে উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার ধানের নমুনা কর্তন শেষে দেখা যায়, ২০ বর্গমিটার জমিতে ১৪.৯ কেজি ফলন (কাচা) উৎপাদিত হয়েছে। যার শুকনো ওজন হবে ১৩.১৬ কেজি। এই হিসাবে হেক্টরপ্রতি এই ধানের ফলন হয়েছে ৬.৫৮ টন।
গোপালগঞ্জ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানী সৃজন চন্দ্র দাস ও ড. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধায়নে এই ধান চাষ নিয়ে কৃষক বিধান চন্দ্র বিশ্বাস জানান, নতুন ধরনের এই ধান-বীজ পেয়ে তিনি চাষে অনেক বেশি যত্নশীল ছিলেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ব্রি ধান-১০৫ এর বীজসহ পরামর্শ পান। এখন বিশেষ এই ধান কোন বাজারে কেমন দামে বিক্রি হবে সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন।
চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিফাত আল মারুফ বলেছেন, পরীক্ষামূলক এই চাষে কৃষক বিধান চন্দ্র বিশ্বাস সফল হয়েছেন। আগামীতে আরও চাষিদের এই ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে। চাষিরা বেশি এই ধান আবাদ করলে ডায়াবেটিক রোগীদের প্রতিষেধকে সহায়তা হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রি-১০৫ থেকে পাওয়া চালে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ তুলনামূলক কম এবং সে কারণেই এটিকে ‘ডায়াবেটিক ধান’ বলা হচ্ছে। দেশে ও বিদেশে এই ধানের চালের বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।