প্রাযুক্তিক শক্তিমত্তার প্রদর্শনী ও তারুণ্যের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্বজয়ের সম্ভানার পথ নকশা এঁকে শেষ হলো চারদিনের বেসিস সফট এক্সপো ২০২৩। চারদিনের মেলায় ১২০ কোটি টাকার চাহিদা পেয়েছেন মেলায় অংশগ্রহণকারী ২০৪ এক্সিবিটর। অংশ নিয়েছে লক্ষাধিক দর্শনার্থী। রাজধানীর ঢাকার অদূরে পূর্বাচলেও প্রযুক্তিপ্রেমীদের এই আগ্রহকে আমলে নিয়ে আয়োজকরা বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন নয়; ২০৩১ সাল নাগাদ ২০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় আসতে পারে এই খাত থেকে। তবে এজন্য সরকারের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তাবায়নে সমানভাবে চালকের আসনে থাকতে চান ব্যবসায়ীরা। সরকারও এই বিষয়ে ত্রিমাত্রিক মিতালি গড়তে কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে মেলার সমাপনীতে।
এসময় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ‘রকস্টার’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
রবিবার রাতে বেসিস সফটএক্সপো’র ১৭তম আসরের এই সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বক্তব্যে ২০২৫ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে কোন নীতি ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলবে সে বিষয়টি ব্যবসায়ীদেরই নির্ধারণের তাগিদ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো প্রযুক্তির জায়গা দখল করছে নতুন প্রযুক্তি। তাই দক্ষতা অর্জনের ওপর উচ্চমাত্রার গুরুত্ব দিতে হবে। সবাইকে লক্ষ্য না করে সুনির্দিষ্টভাবে এই কাজটা করতে হবে। কোন পলিসি সাপোর্ট দিলে বড় ধরনের ইমপ্যাক্ট পড়বে, মৌলিক পরিবর্তন হবে সেটি আপনাদেরকে বের করে সরকারকে জানাতে হবে।’।
তবে বড় পরিসরের পরিবর্তে ছোট ছোট করে এগোনোর পরমার্শ সফল এই ব্যবসায়ী উপদেষ্টার। তিনি বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা এসেছে। আমারে মনে হয় এটাতে বিশেষভাবে নজর দিয়ে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করতে হবে। তবে সেটা সবাইকে নয়, এটা খুঁজে বের করে যাদের দিয়ে কাজ হবে এমনদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা বলছি, এসব ২০২৫ সালের মধ্যে করতে হবে। কিন্তু আমার কথা হলো কেন সেটা ২০২৩ সালের মধ্যে নয়। আমি চাই এটা শুরুটা হোক এ বছরেই। ২০২৩ সালের মধ্যে তাই ১০০ জন করে আইওটি, রোবটিকস ও সাইবার সিকিউরিটিতে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলা উচিত।
বিনিয়োগ উপদেষ্টা বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা এসেছে। আমারে মনে হয় এটাতে বিশেষভাবে নজর দিয়ে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করতে হবে। তবে সেটা সবাইকে নয়, এটা খুঁজে বের করে যাদের দিয়ে কাজ হবে এমনদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে।
এজন্য শিক্ষক নয় শিক্ষার্থীদের গবেষণা অনুদান দেয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তিনি বলেন, একটা সময় কিন্তু শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে কোনো অর্থ দেওয়া হতো না। সেটা এখন পরিবর্তন করা হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে আমি মনে করি, ট্রেড বডির যে কাজ সেটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহযোগীতা করা। বেসিস সেটি করছে। আমি মনে করি এটিও অব্যাহত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে উদ্ধৃতি দিয়ে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ যে কথা বলেছেন যে এসব সহযোগিতা দিলে বেসিসকে দাবায় রাখা যাবে না, আমারও এই মেলা দেখার পর মনে হয়েছে বেসিসকে দাবায় রাখা যাবে না।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আাইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, আইসিটি উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন আইসিটি বিভাগের এখন কাজ হবে সিভিল কনস্ট্রাকশন নয়, সফটওয়্যার ও সফট স্কিল ডেভেলপ করা। তাই আমরা তিনটি টার্গেট নিয়েছি। এ বছর থেকে কোডিং, প্রবলেম সলভিং স্কিল কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করেছি। এখন ২০২৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল থেকে ১০ লাখ কোডার তৈরি করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি পর্যায়ে আরো ১০ লাখ প্রোগ্রামার তৈরি করবো যারা বেসিস এর ওয়ার্কফোরর্স হিসেবে কাজ করবো। এর পাশাপাশি ব্লেন্ডেন্ড পদ্ধতিতে সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্বে আরো ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করবো।
তিনি আরো বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে মাননীয় উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ভাই আগে সরকার ও বেসিরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে মুখোমুখি অবস্থায় ছিলো সেখান থেকে টিম ওয়ার্ক স্পিরিট কালচার সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের সরকারের মধ্যে একটি অন্টারপ্রেনিয়র মাইনসেট গড়ে তুলেছেন। যার ফলে আইসিটি বিভাগ ও বেসিস মিলে একটি পরিবারের মতো একসাথে কাজ করি।
বক্তব্যে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই তিনটি অনুষঙ্গের সঙ্গে আরো তিনটি বিষয় যুক্ত করে পলক বলেন, সরকার একটি নীতি প্রণয়ন করলে সরকার তার বেনিফিট বেসরকারি খাত শতগুণ বেশি পেতে পারে। এই যেমন সরকার যদি ২০২৪ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিতো তাহলে আজকের আইসিটি খাত এতোটা বিকশিত হতো না। গভঃ, একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সমন্বয়ের সঙ্গে তারুণ্যের অফুরাণ দক্ষ জনশক্তি কাজে লাগাতে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যা ব্যবসায় বান্ধব ও সহায়ক। এছাড়াও বিশ্ব চাহিদা যোগানের উপযোগী করে ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করবো।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ জানান, এক্সপোর চতুর্থ দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯২ হাজার দর্শনার্থী সফটএক্সপো ভ্রমণ করেছেন। এছাড়া অংশগ্রহণকারী ২০৪টি কোম্পানি ইতিমধ্যেই স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে প্রায় একশ বিশ কোটি টাকার সম্ভাব্য লিড পেয়েছে। ঢাকার বাইরে হলেও এটি একটি মাইলফলক।
‘থ্রি বাই থ্রি’ ফর্মুলার কথা আবারও পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি মনে করি ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি যে চ্যালেঞ্জ পেয়েছি তা মোটেও অসম্ভব নয়। শুধু ৫ বিলিয়ন ডলার নয়, ২০৩১ সাল নাগাদ আমরা এই খাত থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি। সেজন্য আমাদের সরকার, ইন্ডাস্ট্রি ও অ্যাকাডেমিয়া এই তিনটি স্টেকহোল্ডারের একসাথে তিনটি কাজ করতো। কাজগুলো হলো- তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যথাযথ রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট, বিদেশে আমাদের সক্ষমতা তুলে ধরতে ইন্ডাস্ট্রি ব্র্যান্ডিং এবং সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে দক্ষ জনবল তৈরি করা।
অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এক্সপো কমিটির আহ্বায়ক বেসিস পরিচালক আহমেদুল হক বাবু।
এর আগে বেসিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি সামিরা জুবেরী হিমিকার সঞ্চালনায় আলোচনায় স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আরো ব্যবসায় বান্ধব নীতিমালার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন ব্যবসায় নেতারা। এই আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের সিইও নাসের এজাজ বিজয় এবং ফাইবার অ্যাটহোম চেয়ারম্যান মঈনুল হকসিদ্দিকী।
বক্তব্যে মঈনুল হক বলেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফটওয়ার অ্যাডাপ্টেশন ও ইউটিলাইজেশন করতে হবে। আর আন ইন্টারেপ্টেড সংযোগের জন্য তারহীন প্রযুক্তিকে শক্তিশালী করতে হলে ফাইবার নেটওয়ার্ককেই গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে আমরা ২০৪১ সালের আগেই নিজেদেরকে উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।
গত ১০ বছরে ডিজিটাইজেশনের মহাসড়কটি হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ভার্চুয়ালাইজেশন ও স্মার্টনেসের সময়। আমাদের ডেটা ড্রিভেন সোসাইটির জন্য ডেটা সেন্টারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ক্লাউড ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত হতে হবে। এখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। বেসিস এই বিষয়টি কাজ করতে পারে।
চিটাগাং স্টক এক্সেঞ্জ চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, “দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার মধ্যে যে বন্ধনটা থাকা উচিত তার ধারে কাছেও আমরা নেই।”
“সরকার ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য সহায়তা দিয়েছে, তবে এটি যদি অন্য কিছু নীতিগত সহায়তা দেয়, বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে, তাহলে এই খাতের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হবে। এনবিআর যতদিন না ঠিক হবে, ততদিন দেশের ব্যবসার পরিবেশ বদলাবে না“- যোগ করেন তিনি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের জমি ও সম্পদ সীমিত, তাই ডিজিটাল অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেক্টরটি স্কেলযোগ্য হতে পারে একটি ত্বরান্বিত পদ্ধতি। তবে অংশীদারিত্বের জায়গা থেকে আমরা খুব একটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। এজন্য যতটা পাড়া যায় স্যান্ডবক্স সৃষ্টি করতে হবে। সিড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে নতুন উদ্যোগকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বেসিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি সামিরা জুবেরী হিমিকা। অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এক্সপো কমিটির আহ্বায়ক বেসিস পরিচালক আহমেদুল হক বাবু। ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয় অতিথি, পৃষ্ঠোপোষক এবং অংশগ্রহণকারীদের হাতে। মেলার সেরা প্যাভিলিয়ন হয়েছে ফ্লোরা সিস্টেম। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে ইন্টেলিজেন্ট মেশিন এবং রিভ সিস্টেমস। অপরদিকে স্টল ক্যাটাগরীতে প্রথম গতিপথ, ই-শিখন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সিম্ফোনি সফটওয়্যার লিমিটেড। এছাড়াও মিনি স্টল প্রথম ড্রিম ওয়ানলাইন, দ্বিতীয় টিমেক্সাস এবং তৃতীয় আদর্শ প্রাণীসেবা।
‘ওয়েলকাম টু স্মার্টভার্স’ স্লোগান অনুষ্ঠিত ‘বেসিস সফটএক্সপো-২০২৩ ’-কে বলা যেতে পারে পরিবেশ বান্ধব মেলা। কেননা, এবারের সফটএক্সপোতে কাগজের ব্যবহার ছিল ন্যূনতম; বিশেষ করে সফটএক্সপোর চাকরি মেলার আয়োজনটি ছিল সম্পূর্ণ কাগজবিহীন। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্টলের কিউআর কোড স্ক্যান করে ওই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এক্সপোর বেশির ভাগ স্টল কাগজের লিফলেটের বদলে ব্যবহার করেছিল কিউআর কোড। এছাড়াও কার্ডের বিকল্প হিসেবে স্মার্ট বিজনেস কার্ড ব্যবহার ছিলো চোখে পড়ার মতো। স্টলগুলোতে বলতে গেলে প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিলো না। ত্রিপলে ব্যবহার করা হয় পরিবেশ বান্ধব পাটের ত্রিপল। পানি পানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে কাগজের পাত্র।