ডিজিটাল বাংলাদেশ গন্তব্যের পর গত ৭ এপ্রিল রূপকল্প ২০৪১ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্ক ফোর্সের ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের নির্দেশনায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সেই কনসেপ্ট পেপারের ওপর ভিত্তি করে সোমবার (১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আইসিটি ডিভিশনের মিলনায়তনে অংশীজনদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী কর্মশালা।
কর্মাশালায় অনুকরণ নয় নিজস্ব উদ্ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে সভাপতির বক্তব্যে স্মার্ট বাংলাদেশের একটি সংজ্ঞাও পেশ করেছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। স্মার্ট বাংলাদেশের সংজ্ঞায় তিনি বলেন, সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদিপ্ত, জ্ঞান ভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী প্রাযুক্তিক সমাধানই হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
উদ্ভাবনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই এমন কিছু উদাহরণ টেনে পলক বলেন, আমরা বাংলাদেশে কম্পিউটার কাউন্সিলের উন্মুক্ত এআই প্লাটফর্ম তৈরি করছি। বিকাশ ও সিটিব্যাংকের যৌথ অংশীদারিত্বে ‘ন্যানো লোন’ লঞ্চ করেছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এক মিনিটে এই ঋণ ছাড় দিচ্ছে। এই এআই এখন কিভাবে শিক্ষা, কৃষি ও অন্যান্য জায়গায় ব্যবহার করা যায় তা বের করতে হবে। আইসিটি বিভাগের সহায়তায় ইউআইইউতে তৈরি ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস গবেষণাগারে ইলন মাস্কের মতো এআইইউবি’র শিক্ষক ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুনের তৈরি সেন্সর দিয়ে আমি আমার ব্রেইন ব্যবহার করেই লাইট অন-অফ এবং গেম খেলতে পেরেছি। নাটরের দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনলোজি’র টিম মহাকাশের তৈরি রোবট নাসা জয় করেছে। এমআইটিতে গত বছরের বর্ষসেরা গবেষণা পত্র হয়েছে বুয়েটের শিক্ষক নাদিম চৌধুরীর গবেষণা। তার ১৬টি উদ্ভাবন ইতিমধ্যেই পেটেন্ট হয়েছে। এর ৫টি এমআইটি ন্যানো ল্যাবের সঙ্গে যৌথ অংশিদারিত্বে হয়েছে। এখন বুয়েট উপাচার্যের সম্মতি পেলে ১০ মিলিয়ন ডলারে আমরা বুয়েট- আইসিটি এমআইটি ন্যানো ল্যাব স্থাপন করবো। যেখানে কাপড়ের সুতোর মধ্যে ন্যানোচিপ স্থাপন করে ভবিষ্যত পোশাক শিল্পেও নেতৃত্ব দিতে পারবো।
সাশ্রয়ী শক্তি হিসেবে ইলেকট্রিক গাড়ির বাড়ন্ত চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যেই এটুআই আইল্যাব দেশীয় প্রযুক্তির একটি অনন্য ইলেক্ট্রিক গাড়ির নকশা করে দিয়ে তা উৎপাদনও শুরু হয়েছে জানিয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন যদি বিআরটিএ, শ্রেডা ও বিদ্যুৎ বিভাগ সহায়তা করলে সেপ্টেম্বরে এটা লঞ্চ করা সম্ভব হবে। তখন নিম্নবিত্তের মানুষও গাড়ি কিনতে পারবে। গ্রামেও যানজোটের যে মিম বানিয়েছে তাও বাস্তবে রূপান্তরিত হবে।
বক্তব্যে গত ৬ জুলাই হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বোর্ড অব গভর্নস অথরিটির বৈঠকে আইসিটি উপদেষ্টার দেয়া গাইড লাইন অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মাইক্রো চিপ ডিজাইনিং ও ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে এগিয়ে থাকতে অংশীজনদের ভাববার পরামর্শ দিয়ে সবার সামনে সাতটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন প্রতিমন্ত্রী। পাশাপাশি ‘আজকে এয়ারবাস, বোয়িং বিমান তৈরিতে নেতৃত্ব দিলেও আগামীতে নরসিংদীর নবম শ্রেণীর ছাত্র কিংবা ময়মনসিংহের নাহিয়ানদের মতো তরুণা পৃথিবীতে পরিবহণ ব্যবস্থায় অভ্যুত্থান ঘটাবে’ বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন জুনাইদ আহমেদ পলক।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঞ্চালনায় অংশীজন সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। এসময় তিনি বলেন, শহরে বসবাসরত মানুষের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে আমাদের অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে। আইসিটি বিভাগ জনবান্ধব সেবা প্রদানে ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। স্থানীয় সরকার ও আইসিটি বিভাগ সাধারণ মানুষের আশা পূরণে সামনের দিনে সম্মিলিতভাবে জনকল্যাণমূলক কাজ করতে পারে। স্মার্ট সিটি বাস্তবায়নে নির্ধারিত এলাকার বসবাসরত জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে ওই এলাকার জন্য মাস্টারপ্লান তৈরি করতে হবে।
অলোচনায় স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে নিজেদের মত তুলে ধরেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপিত ইয়াফেস ওসমান, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ঢাকা উত্তর মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম এবং বুয়েট উপাচর্য সত্য প্রসাদ মজুমদার ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান।
বক্তব্যে শিক্ষা মন্ত্রী বলেন, আমাদের কার কোন জায়গায় কাজ করার সুযোগ আছে, তার একটি সুনির্দিষ্ট ক্যানভাস তৈরি করতে হবে এবং প্রত্যেকের কাজগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। আমরা বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিবান্ধব, প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দক্ষ মানুষ তৈরি করতে চাই। যাদেরকে মানবিক ও সৃজনশীল হতে হবে।
বুয়েট এর উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য বুয়েট-এ এরই মধ্যে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের উন্নয়নের জন্য এগ্রিকালচার, পাওয়ার এবং অন্যান্য সেক্টরের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করা হচ্ছে। দেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট এগ্রিকালচার তৈরিতে বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে কাজ করছে। স্মার্ট ভিলেজের অন্যতম উপাদান স্মার্ট এগ্রিকালচার। স্মার্ট এগ্রিকালচার-এর জন্য আইওটি ডিভাইস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, স্মার্ট এগ্রিকালচারের জন্য ন্যানো টেকনোলজি এবং এআই ব্যবহার করে পরিকল্পনামাফিক কতটুকু সার ও ওষুধ দেওয়া লাগবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। প্রযুক্তি ব্যবহারে আগামী দুই বছরে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে। উচ্চফলনশীল ধান চাষাবাদের মাধ্যমে আগামীতে ধানের উৎপাদন বহুগুণে বাড়াবে। ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে এবং আমদানি না করতে হলে আমাদেরকে কোনো দুঃচিন্তা করতে হবে না।
এছাড়াও অনলাইনে যুক্ত হয়ে সভায় বক্তব্য রাখেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। অংশীজন সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল আলম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে গবেষণা ও উদ্ভাবনার মাধ্যমে ‘২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্ব প্রযুক্তিতে নেতৃত্ ‘ দেয়ার প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেন এটুআই প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মাদ হুমায়ুন। এছাড়াও স্মা্ট বাংলাদেশে একটি প্রতিচিত্র ও করণীয় বিষয়ে উপস্থাপনা করেন এটুআই নীতি উপদেষ্টা আনীর চৌধুরী।
স্মার্ট বাংলাাদেশ বাস্তবায়নে নকিয়া বেল ল্যাবের সহায়তা করার বেশ কিছু ক্ষেত্র তুলে ধরেন নকিয়া বাংলাদেশের প্রধান মোহাম্মাদ আরিফুল ইসলাম। এছাড়াও উপস্থাপনায় ভবিষ্যত প্রযুক্তির বিষয় তুলে ধরেন নকিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ড্যানিয়েল জাগার ও নর্থ আমিরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক এলিসন। উপস্থাপনায় তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আই. ও. টি, রোবোটিক, ব্লক চেইন, বিগ ডাটা এনালাইসিস, ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার কীভাবে একটি অঞ্চলকে স্মার্ট করে তোলে তা তুলে ধরেন।