গ্রামের মানুষেরা এখনও ই-সেবা গ্রহণ ও ব্যবহারে পিছিয়ে আছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং ব্যবহার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকায় তারা পশ্চাদপদ। গ্রাম ও শহরের মাঝে চলমান এই “ডিজিটাল প্রভেদ”এর কারণে ই-গভর্নমেন্ট প্রক্রিয়া পুরো দেশে সফলভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না।
রবিবার (১৩ সেপ্টেম্বার) ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) আয়োজিত ওয়েবিনারে এমন তথ্য উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ডঃ ওয়াসেল বিন সাদাত।
সারাদেশের ৬,৫০০ গ্রামীণ পরিবারের ওপর সমীক্ষা করে এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ডিজিটাল সাক্ষরতা কতটুকু, তা দেখা যায় ডিজিটাল লিটারেসি ইনডেক্স (ডিএলআই)-এর মাধ্যমে এবং ডিএলআই তৈরিতে এ ধরণের গবেষণা এবারই প্রথম করা হলো। ইনডেক্স অনুযায়ী, ৯৬% পরিবারের মোবাইল ফোন থাকলেও তাদের অধিকাংশরই (৫৯%) স্মার্টফোন নেই। এছাড়া, অর্ধেক পরিবারের কম্পিউটার (৪৯%) এবং ইন্টারনেট সংযোগ (৫৪%) নেই।
সামগ্রিক ডিজিটাল সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এই পরিবারগুলোকে “শূন্য”, “কম”, “ন্যুনতম”এবং “ন্যুনতমের উর্ধ্বে”এই ৪টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ পরিবার “কম”এবং মাত্র ৪% পরিবার “ন্যুনতমের উর্ধ্বে”রয়েছে।
ডিজিটাল অ্যাক্সেস (ডিজিটাল সুবিধা পাওয়ার সক্ষমতা) হলো ডিজিটাল শিক্ষার দু’টি মাত্রার একটি; অন্যটি ডিজিটাল স্কিল (দক্ষতা অর্জন) যেটি মানুষকে যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ এবং সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৬৮% এসএমএস পড়তে/লিখতে পারে, ১০% ইমেইল দেখতে ও পাঠাতে পারে, ১৫% ভিডিও কল করতে পারে, ৪১% সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে পারে এবং ২৮% সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত দিতে পারে। অন্যদিকে ইন্টারনেট খুঁজে তথ্য পাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ২৭% মানুষের এবং ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে জনসেবা সম্পর্কিত তথ্য বের করতে পারে ৫৯% মানুষ। কিন্তু যখন কোন সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন আসে তখন দেখা গেছে, অংশগ্রহনকারীদের এই ব্যাপারে দক্ষতা বেশ কম। যেমন, তাদের ৩% মোবাইলের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করতে পারে, ৬% কম্পিউটার ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, ২০% ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিবিধ কাজ (যেমন সংবাদ পাঠ, অনলাইন প্রশিক্ষণ ইত্যাদি) করতে পারে, ৩ শতাংশের আছে অনলাইনে কেনাকাটার অভিজ্ঞতা এবং ১ শতাংশেরও কম মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে আয় করতে সক্ষম।
ডিজিটাল অ্যাক্সেসের মতোই, এই পরিবারগুলোকে ডিজিটাল স্কিলের উপর ভিত্তি করে ৪ টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সেখানেদেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবারের দক্ষতা “কম”, ১৬% এর দক্ষতা “শূন্য”, ১৫% পরিবারের “ন্যুনতম”দক্ষতা আছে এবং ৮% পরিবারের দক্ষতা “ন্যুনতমের উর্ধ্বে”।
এই গবেষণায় দুটি মাত্রার মাধ্যমে ডিএলআই এর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছেঃ ডিজিটাল অ্যাক্সেস এবং ডিজিটাল স্কিল। গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং খুলনা বিভাগের পরিবারগুলোতে ডিজিটাল অ্যাক্সেস, ডিজিটাল স্কিল এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার হার বেশি। অন্যদিকে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে এই হার বেশ কম।
এছাড়া ডিজিটাল অ্যাক্সেসের সাথে ডিজিটাল স্কিলের ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলেও দেখা গেছে, পরিবারের উপার্জন ওই পরিবারের ডিজিটাল সাক্ষরতা, দক্ষতা ও সক্ষমতার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পরিবারের আয়তন ডিজিটাল অ্যাক্সেসের উপরে বড় প্রভাব রাখলেও ডিজিটাল দক্ষতার উপরে তেমন প্রভাব ফেলে না।
অন্যদিকে, পরিবার প্রধানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিজিটাল অ্যাক্সেস, ডিজিটাল স্কিল ও সাক্ষরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পরিবার প্রধানের লৈঙ্গিক পরিচয় ডিজিটাল অ্যাক্সেসে খুব একটা প্রভাব না ফেললেও দেখা গেছে, নারী-প্রধান পরিবারে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার বেশ ভালো।
ডঃ সাদাত তার উপস্থাপনায় মানুষের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ানোর উপরে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নতুন কর্মযুগের সূচনালগ্নে এটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি খুব দ্রুত একটি জাতীয় ডিজিটাল কমপিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির তাগিদ দেন যেটি এই “ডিজিটাল প্রভেদ”রোধ করবে।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, “গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআইজিডি-তে আমরা ডিজিটাইজেশনের একটি পুরো সামাজিক বিজ্ঞান তৈরি করতে চাই যেটি আসছে বছরগুলোতে খুবই অর্থবহ হবে। এই সার্ভেটি ডিজিটাল সামাজিক বিজ্ঞানের একটি অংশ। আজকে আমরা যা আলোচনা করলাম, তার আরও নানান দিক রয়েছে যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।“
বিআইজিডির রিসার্চ ফর পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (আরপিজি) এর প্রধান মেহনাজ রাব্বানী বলেন, “ই-গভর্নমেন্ট পদ্ধতি প্রণয়ন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন বেশ বড়সড় একটি জনগোষ্ঠী যারা ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত। এই শিক্ষা শুধুমাত্র ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে প্রতিফলিত হবে না, তাদের আচরণেও প্রতিফলিত হবে। এবং অন্যান্য আচরণগত পরিবর্তন যেভাবে আসে, এটির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমন উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োজন।“
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, “যখন চাহিদা বাড়ে, তখন জনগণের মাঝে পরিবর্তনের আগ্রহও বৃদ্ধি পায়। ই-সেবাগুলোর চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই চাহিদা ডিজিটাল লিটারেসি (সাক্ষরতা)-র ক্ষেত্রেও বাড়ছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল লিটারেসি অর্জনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো।“
সিজিপিএ এর পলিসি প্রধান গ্রেগরি চেন বলেন, “ডিজিটাল লিটারেসি (সাক্ষরতা) হলো অসংখ্য নির্ধারকের পারস্পরিক সম্পর্কের ফলাফল। শুধুমাত্র যখন সব নির্ধারকগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে, তখন ডিজিটাল লিটারেসি উন্নত হবে।“
অন্যান্যদের সাথে এই ওয়েবিনারে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, এটুআই এর পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী, ইকোনোমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি) এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ সাজ্জাদ জহির, সিজিএপি এর পলিসি প্রধান গ্রেগরি চেন এবং বিআইজিডির রিসার্চ ফর পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (আরপিজি) বিভাগের প্রধান মেহনাজ রাব্বানী আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।