বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হৃদরোগ চিকিৎসায় সর্বাধুনিক ‘রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি’ প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা। রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোবট দিয়ে সফলভাবে দু’জন হৃদরোগীর হার্টে স্টেইন (রিং) পড়িয়েছেন তারা। দুই ব্যক্তির একজন কুষ্টিয়ার কৃষিক আজম আলী এবং অন্যজন সৌদি প্রবাসী চাঁদপুরের মোর্শেদ আলম (৫০)। শল্যচিকিৎসার পর দিনই দু’জন সুস্থতা বোধ করেন এবং হেঁটে চলে বেড়াতে পেরেছেন।
এর মাধ্যমে চিকিৎসায় সফল রোবটিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। রোববার রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির উদ্বোধন করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক মো. কামরুল হাসান (মিলন) এবং কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. সালাউদ্দিন উল্লুবি।
এনজিওপ্লাস্টির নেতৃত্বদানকারী চিকিৎসক প্রদীপ কুমার কর্মকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চিকিৎসক দলে তার সঙ্গে ছিলেন পিনাকী রঞ্জন দাস, আরিফুর রহমান, সাইদুর রহমান, ফারহানা আহমেদ, মো. হোসনি আমীন, বাদল চন্দ্র বর্মন, নাজমুল হক ভূঁইয়া, আবু সালেহ ও নুসরাত রহমান।
প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, রোবোক্যাথ আর ওয়ান সিস্টেমে ক্যাথল্যাবে একটি রোবোটিক হাত থাকে। আর দূর থেকে একটি মেশিনে তা নিয়ন্ত্রণ করেন চিকিৎসকেরা। আগে চিকিৎসকেরা সরাসরি নিজের চোখে দেখে নিজের হাতে যে কাজটি করতেন, তা–ই এখন করা হচ্ছে রোবটের মাধ্যমে। এতে কাজটি অনেক নিখুঁত হচ্ছে। অস্ত্রোপচারে সময় কম লাগছে। এই দুই রোগীর অস্ত্রোপচারে সময় লেগেছে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট যা সরাসরি করলে লাগত এক ঘণ্টার বেশি।
- ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তার দলের সফল প্রচেষ্টা
- ফ্রান্সের তৈরি রোবটের দাম ৫ কোটি টাকা
- এক মাস থাকবে বাংলাদেশে, ১০ রোগীর বিনামূল্যে রিং
- অবকাঠামো সহায়ক হলে সরকারকে কিনতে বলবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
তিনি জানান, তারা ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে রোবটটা এক মাসের জন্য এনেছেন, দেশের অবকাঠামোতে এটি খাপ খায় কি না সেটা দেখার জন্য। ওই রোবট কোম্পানি রোবটের সাথে ১০টি ডিভাইস দিয়েছে। এসব ডিভাইস দিয়ে ১০ রোগীকে বিনামূল্যে রোবটের মাধ্যমে রিং পড়ানো যাবে। এটা সফল হলে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারকে অনুরোধ জানাবে রোবট কিনে দেওয়ার জন্য। এতে দেশে স্থায়ীভাবে রোবোটিক পদ্ধতিতে হার্টের রিং পরানো সম্ভব হবে। তখন চিকিৎসার মোট খরচের সঙ্গে রোগীকে বাড়তি মাত্র ২০ হাজার টাকা যোগ করতে হবে। আর যে রোবট দিয়ে এনজিওপ্লাস্টি করা হয়েছে, সেটি ফ্রান্সের তৈরি ও দাম ৫ কোটি টাকা।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, এখন তারের সংযোগে রোবট দিয়ে সার্জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ রোগী ছিল ভেতরে, আমরা ছিলাম বাইরে কন্ট্রোল রুমে। ওয়ালেস সুবিধাতেও এটা করা যাবে। আমাদের লক্ষ্য হলো হাসপাতালের বাইরে থেকে কন্ট্রোল ইউনিট নিয়ে এনজিওপ্লাস্টি করা। এক্ষেত্রে আমরা হাসপাতালে থেকে রোবট দিয়ে দেশের যে কোনো প্রান্তে রিং পড়াতে পারবো।
কীভাবে কাজ করে রোবট
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমান পৃথিবীতে হার্টের রিং পরানোর সর্বাধুনিক এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি। কার্ডিওলজিস্টরা এখনো ক্যাথল্যাবে নিজেরা রোগীর কাছ থেকে রোগীদের হার্টের রিং পরান। কিন্তু রোবটের মাধ্যমে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর চেয়ে দূরে থেকে নিখুঁতভাবে হৃদরোগীদের হার্টের ধমনীতে রিং পরান। এই রোবটের দুটি অংশ থাকে একটি হলো রোবটের একটি হাত যা ক্যাথল্যাবে থাকে। আরেকটি থাকে কন্ট্রোল সেকশন, যেখান থেকে মূল কার্ডিওলজিস্ট পুরো রিং পরানো কার্যক্রমটি দূর থেকে সম্পন্ন করে থাকেন।
কী সুবিধা এই সার্জারিতে
রোবটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হল হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হল হৃদরোগ চিকিৎসকগণ সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে ও জটিলতাও কম হয় । যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন, এক সময় তারা দুটি সমস্যায় পড়েন। প্রথমত হল রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যান্সার ও চোখে ক্যাটারাক্টসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ঝুঁকিতে পড়েন। এছাড়া হৃদরোগ চিকিৎসকরা যখন অপারেশন থিয়েটার বা ক্যাথলেবে কাজ করেন রেডিয়েশন প্রটেকশন এর জন্য তারা ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ জামা দীর্ঘক্ষণ যাবত পরতে হয়। ফলে ঘাড়ের নার্ভের চাপ পড়ে এবং পরবর্তীতে চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ও হাতে ব্যথার কারণে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়াই এবং ভারী বিশেষ জামা পড়া ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোলরুমে, তার অফিসে, সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে অথবা দেশের বাইরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হার্টের রিং পরাতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমানে হার্টের রিং পরানোর সর্বাধুনিক ও সর্বশেষ প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের ১৬০টি দেশে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি সেন্টার আছে। রোবটিক করোনারি আটারি বাইপাস গ্রাফ্ট বা সিএবিজি ভারত ও সিঙ্গাপুরে হচ্ছে। ভারতে ১৯১৮ সালে অধ্যাপক ডা. তেজেশ প্যাটেল এটা প্রথম শুরু করেন। তিনি যখন প্রথম রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি করেন তখন তিনি তার থেকে প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার দূরে এক রোগীর হার্টের রিং পরান । তখন থেকে এটি সারা বিশ্বে শুরু হয় এবং এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে, প্রতিনিয়ত গবেষণা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি এর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। অবশ্য ২০২০ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ট্রান্স ক্যাথেটার এউটিক ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট বা টিএভিআর পদ্ধতিতে বুক না কেটে হার্টের ভাল্ব প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর টিএভিআর পদ্ধতিতে এউটিক ভাল্ব প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে এইচ ও সি এম বা হাইপারট্রপিক অবস্ট্রাক্টিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি চিকিৎসা করেছেন রোবটিক রিং পড়ানোতে নেতৃত্ব দানকারী চিকিৎসক প্রদীপ কুমার কর্মকার।