মাহমুদুল হাসান সোহাগ। পরিচিত মহলে তার পরিচিতি সোহাগ নামে। বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী থাকার সময় জড়িত ছিলেন গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা পেরোনোর আগেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বানিয়ে আলোচনায় আসেন। ভেটিং মেশিরে জন্য বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি নিয়ে পাইল্যাবস ছাড়াও গড়ে তোলেন ‘অন্যরকম গ্রুপ’। তবে সব ছাপিয়ে বছর জুড়েই আলোচনায় থাকে তার প্রতিষ্ঠিত বই বিক্রয়ের শীর্ষ ই-কমার্স সাইট রকমারি.কম।প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তিনি। অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাসে এই বইয়ের অনলাইন মুখীতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, রকমারি বেষ্ট সেলার বুক, বেষ্ট সেলার লেখক, সেরা ক্রেতার পুরস্কার ফেব্রুয়ারি মার্চ-দুই মাস ধরেই চলবে।
আপনি তো কোচিং করাতেন। এরই মধ্যে বই বিক্রি করার সাধ জাগলো কেন?
আমি বড় হয়েছি জামালপুর জেলার সরিষা বাড়ি থানায়। একবার বৃত্তির টাকা নিয়ে ঢাকায় আসলাম বই কেনার জন্য। বই কিনতে নিউ মার্কেট গিয়ে এত এত বই দেখে আমার পাগল পাগল লাগছিল। তখন মনে হয়েছিল আমারও যদি এইরকম একটা বইয়ের দোকান থাকত। আজকে আমিও একটা বইয়ের বিশাল সাম্রাজ্যের মাঝখানে আছি। আজকে এমন একটা প্রতিষ্ঠান চালাই বা আমি এমন একটা প্রতিষ্ঠানের পার্ট যে আমি অনেকগুলা বইয়ের মাঝখানে থাকি। এই যে অনেক বইয়ের মাঝখানে থাকতে পারি এটা অনেক আনন্দ দেয়। আমরা রকমারি শুরু করি ২০১২ সালে। কারওয়ান বাজারে আমাদের যে অফিস ছিল সেখানে দুই তিনজন মিলে বই এন্ট্রির কাজ করত। সে বছরের ১৯ জানুয়ারি আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি আসতেছে আসতেছে ভাব। তখন আমরা রকমারিকে মতিঝিলে ট্রান্সফার করি। টোটাল রকমারির তখন সাইজ ছিল পাঁচ থেকে ৬ জন মানুষ, অল্প কিছু বই, আর কিছু ফার্নিচার। সব মিলিয়ে ছোট্ট একটি কাভার্ড ভ্যান, সেটাও পুরো ভরে নাই। ২০১২ তে রকমারির সাইজটা এমনই ছিল। আর আজকে আল্লার রহমতে অনেক অনেক বই নিয়ে কাজ করতেছি, অনেকজন মানুষ আমরা। এটা ভালো লাগে যে মানুষের কাছে বই পৌঁছানো আমরা শুরু করেছিলাম। আমরা কতটুকু কি করেছি তার চেয়ে বড় কথা আমরা একটা চেষ্টা করেছি।
রকমারি কীভাবে এতো বড় হয়ে উঠল?
আমি যদি কিছু পরিসংখ্যান শেয়ার করি তাহলে দেখব, আমরা যখন রকমারি শুরু করি তখন আমরা ১০ হাজার বই নিয়ে শুরু করি সেখান থেকে আজ আমাদের লাইব্রেরিতে ২ লাখের মতো বই আছে। দেশি বিদেশি অনেক রকমের বই আছে। শুরুতে আমাদের আড়াই হাজার লেখকের বই ছিল, দিন শেষে আজ ৮০ হাজার লেখকের বই আমাদের আছে। ২০১২ সালে ৫০০’র মতো প্রকাশক ছিল এখন ১৪ হাজারের বেশি প্রকাশকের বই আমাদের এখানে আছে। এই জার্নিটা আমাদের জন্য ওয়ান্ডারফুল একটা জার্নি, ওয়াও ফিল করার মতো ব্যাপার যে আমরা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।
বাংলাদেশের সব জায়গাতে কী পৌঁছতে পেরেছেন?
আমার জানাশোনার মধ্যে যত দূর পর্যন্ত আমি জানতে চেয়েছিলাম আমার টিম ডেটা বের করে দেখিয়েছে যে তারা সেই জায়গাগুলোতে বই পৌঁছাতে পেরেছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম- সন্দ্বীপের লোক বই অর্ডার করে কিনা? হাতিয়ার লোক বই অর্ডার করে কিনা? আরও দূরবর্তী বা নিঝুম দ্বীপ টাইপের এলাকাগুলোতে আমাদের বই যাচ্ছে কিনা? সেখান থেকে দেখলাম যে সব জায়গার মানুষকে আমরা বই পৌঁছিয়েছি। আমাদের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের মাদ্রাসার বই আমাদের অর্ডার করা হয়েছিল যেখানে কোনো ডেলিভারি সিস্টেম ছিল না। আমরা তাদের আগ্রহ দেখে স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করে সেই বই পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। তো এই জার্নির মধ্যে আপনাদের (ক্রেতা, লেখক, প্রকাশক) সহযোগিতা ছিল, আপনারা পাশে ছিলেন, এখনো আছেন, ভবিষ্যতেও আপনারা থাকবেন।’
দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে রকমারি কোন অবস্থানে আছে?
দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এই দেশের এই লেভেলের যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তার মধ্যে আমরাই একমাত্র দেশি কোম্পানি। আমাদের এখানে কোনো বিদেশি ইনভেস্টমেন্ট নেই। আমাদের আরও যে ব্যবসাগুলো আছে সেখান থেকে টুকটাক করে ইনভেস্ট করতে করতে এত দূর এসেছি। শীর্ষ অবস্থানে রয়েছি। দেড় শ’র বেশি টিম মেম্বার আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। চুক্তিভিত্তিক আরও ৬০/৭০ জনের মতো হবে। এই কম রিসোর্সেও যে আমরা এত দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি এর জন্য আমি আমার টিম মেম্বারদের ধন্যবাদ জানাই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, আমার টিম মেম্বারদের ওপর নানা কড়াকড়ি আরোপ করি, কখনো সামনাসামনি বলা হয় না, তবে আজ ক্যামেরার সামনে বলতে চাই- তোমরা না থাকলে এটা হতো না। তোমাদের জন্য আমার অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা। আমরা একটি টিম হিসেবে এত দূর এসেছি এটার জন্য তোমাদের ভালোবাসা, ঐকান্তিকতা- সবকিছুর ফলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
ফেসবুক-টুইটারের মধ্যে দেশে বই পড়ার সাম্প্রতিক প্রবণতাটা কেমন?
একটা বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে যে, আদৌ বই এখন মানুষ পড়ে কিনা? যদিও সারা বাংলাদেশের সামগ্রিক তথ্য আমার কাছে নাই। তবে এতটুকু বলতেই পারি যে লোকজন আজকাল অনেক বই পড়ে। কারণ ফেসবুকের স্ট্যাটাস লোকজন সারা দিনই পড়তে থাকে। সেটাও এক ধরনের পড়া। তবে সেটা ছোট আঙ্গিকে। কিন্তু বই পড়া বা অনলাইনে বই কেনার ব্যাপারে যদি বলি তাহলে আমরা দেখেছি বছর থেকে বছরে বই কেনার হার অনেক বাড়তেছে। আমরা নিজেরাই এর সাক্ষী। এখানে কিছু লক্ষণীয় বিষয় যে, ২০১২ সালে ছিল ফিকশনের জয়জয়কার। তখনো হুমায়ূন আহমেদ স্যার বেঁচে ছিলেন। আমরা তার বইও পেয়েছি। ২০১৩ সাল থেকে ট্রেন্ডটা চেঞ্জ হতে থাকে, এ বছর এসে আমরা দেখলাম যে কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং বা এই জাতীয় বইগুলো, ইন্টারনেট বা লার্নিং-আর্নিং, ফ্রিল্যান্সিং টাইপ বইগুলোর ট্রেন্ড বাড়তে থাকে। ২০১৪/১৫ সাল থেকে এটা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৮/২০১৯ এই দুই বছরের পরিসংখ্যান যদি আমি হাজির করি তাহলে দেখতে পাই যে, ২০১৮ সালের বেষ্ট সেলার বইয়ের মধ্যে মাত্র দুটি বই ফিকশন। আর বাকিগুলো নন ফিকশন যেমন ধরি ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট, শেলফ ডেভেলপমেন্ট, ফ্রিল্যান্সিং জাতীয় বইগুলো। শেষ বছর ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান যদি বলি তাহলে দেখতে পাই, এই বছরে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের ব্যাপক জয়জয়কার। টপ সেলার বইগুলোর মধ্যে যেমন আরিফ, আজাদ, আইমান সাদিক, চমক, ঝংকার মাহবুব। তার মানে যারা একদম ইয়াং তারা লিখতে এসেছে। এটাও দেখলাম যে, ইয়াংদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতাটাও বেশ লক্ষণীয়। কারণ ২০১৯-এ টপ পাবলিশারদের যে লিস্ট আমি দেখতে পাচ্ছি সেখানে ২০১৯ এ টপ-এ ছিল আদর্শ। আদর্শের মাহবুব ভাই যে খুব পুরোনো পাবলিশার তা কিন্তু নয়। সেকেন্ড সমকালীন যারা ইসলামিক বই প্রকাশ করে। ওরাও খুবই ইয়াং সেটআপ। থার্ড হচ্ছে আনন্দ পাবলিশার ভারতের। এটা ভালো যে ভারতীয় একটা প্রতিষ্ঠান টপ তিনে আছে। তবে ভাগ্য ভালো যে এক দুইয়ের মধ্যে নাই। তা না হলে কষ্ট লাগত যে দেশীয় প্রকাশনা কেন এক/দুইয়ে নাই। এরপরে গার্ডিয়ান- এটাও নতুন প্রকাশক। ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ দিয়ে যাদের যাত্রা শুরু। এরপর প্রথমা পুরোনো। ফরিদ পাবলিকেশনস। এরপরে আছে অনন্যা, অন্য প্রকাশ আছে। আমি এখান থেকে একটা ট্রেন্ড ধরতে পেরেছি যে ইয়াংরা যেমন লেখালেখিতে এগিয়ে এসেছে, পড়ার প্রতিও তাদের একটা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে এবং পাবলিশিংয়েও কিন্তু ইয়াংরা আসছে। এটা ভালো যে, পুরোনোরা যেমন তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তেমনি তরুণেরা তাদের উদ্যম দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
ই-বুক চালু কতদূর এগুলো?
আমরা বাংলাদেশ ছাড়াও আরও ৩০টি দেশে বই পৌঁছিয়েছি। ‘মুঠো বই’ নামে ই-বুক লঞ্চ করেছি। এখন খুব কম বই-ই আছে। তবে শিগগিরই অনেক বেশি বই যোগ করতে পারব। প্রবাসী পাঠকরাও দেশি বই পড়তে পারবেন তারা।
রকমারি-তে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা?
আমাদের এখানে বই কেনা ও বই বিক্রি নিয়ে প্রতিদিনই নানা গল্পের জন্ম হচ্ছে। যেমন, একজন বই অর্ডার করছে, ডেলিভারি ম্যান গিয়ে দেখে তিনি একজন ভিক্ষুক। তিনি পড়তে পারেন না। পরে জানা যায়, তিনি একজনকে দিয়ে বইটি পড়িয়ে তিনি শুনবেন। এর বাইরেও আরও ছোট ছোট গল্প তৈরি হয়েছে আমাদের, যেখানে ঠেলাগাড়ি চালক বা মুদি দোকানিরাও বই অর্ডার করেছে।
ভিক্ষুক যে বইটার অর্ডার করেছিলো সেটির নাম?
আর জে কিবরিয়ার ’জীবনের গল্প’।