দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর গ্রামে গ্রামে বাধাহীন ইন্টারনেট সংযোগ সুলভ করতে একের পর এক ইনফো সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। দেশের পার্বত্য অঞ্চল বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিসহ সন্দ্বীপের মতো দুর্গম অঞ্চলের ৬১৭ ইউনিয়নে উচ্চগতির ইন্টারনেট দিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্প। আইসিটি বিভাগের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) যখন কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; তখন মোবাইল অপারেটরের ‘ডাটা সীমা’য় বেঁধে ৪১ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইন্টারনেটে সংযুক্তির কার্যাদেশ দিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী, প্রথমে ৩ পার্বত্য জেলায় ১০০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৬১টি জেলার ৩৯ হাজার ৭০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াইফাই সিস্টেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেবে গ্রামীণফোন। এজন্য অপারেটরটি জেলা প্রাথমিক ষিক্ষা অফিসে ওয়াইফাই-সিস্টেম ও সিম ব্যবহার করবে।
শিক্ষা অধিদপ্তরের এমন পদক্ষেপে উষ্মা প্রকাশ করছেন নেটিজেনরা। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে বিষয়টি নিয়ে খেদ প্রকাশ করে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইনফোলিংক সিইও সাকিফ আহমেদ লিখেছেন, “যেখানে সুযোগ আছে দেশিও কোম্পানি কে কাজ দেয়া। ৪১০০০ কানেকশন দিয়ে আনুমানিক ছোট সাইজ এর ৪১টা ইন্টারনেট কোম্পানি চলতে পারতো, সেখানে একটি বিদেশি কোম্পানি কে আওতায় পরে না এমন কাজ দিয়ে টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিবার কি কারণ থাকতে পারে? মোবাইল কোম্পানির কাজ কি ওয়াইফাই ইন্টারনেট দেয়া?”
প্রশ্ন উঠেছে, ৫ এমবিপিএস গতির ২০ জিবিপিএএস ডেটা দিয়ে কীভাবে পুরো এক মাস একটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মিটবে তা নিয়ে। মূলত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদি ছাত্রদের জন্য ইন্টারনেট দেওয়া নাও হয় তবে ন্যূনতম ১০টি শ্রেণী কক্ষকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করতে হলে একেকটি শ্রেণীকক্ষের জন্য ২জিবি ডেটা মিলবে। শ্রেণী কক্ষে যদি কোনো অনলাইন ভিডিও চালাতে হয় তাহলে এই ডেটায় এক দিনও যাবে না। তাছাড়া যেখানে মোবাইল ইন্টারনেটের মানদণ্ড ধরা হয় ২০ এমবিপিএস গতিকে সেখানে কীসের ভিত্তিতে বা কার স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫এমবিপিএস করলো তা রহস্যাবৃত খোদ সরকারের ডিজিটাল রূপান্তরের নেতৃত্বদানকারীদের কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডিজিবাংলা-কে বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া কারিগরিভাবে কোনো দিক দিয়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। যেখানে আমি ব্রডব্যান্ড নিতে পারি সেখানে কী কারণে আমরা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করবো সেটা আমার মাথায় আসে না। শিক্ষাক্ষেত্রে সেই গতিটা খুব জরুরী। সেই গতি না থাকলে এটা কী কাজে আসবে? আমার কাছে মনে হয়, মোবাইল আমাদের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। হাইস্পিড ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে এই সেবাটা দেয়া যুক্তি সঙ্গত ছিলো। অথচ এই দরপত্রে আইএসপিগুলোকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। এটা মোটেই উচিত হয়নি। এটা কারিগরি দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছ থেকে তাদের পরামর্শ নেয়া উচিত ছিলো কোনটা সঠিক। তাছাড়া কার্যাদেশ পত্র দেয়ার পর বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে আইএসপিএবি। আগে যদি জানাতো তাহলে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারতাম। এখন আমাদের কিছুই করার নেই। তবে এটা মোটেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। কেননা, যেখানে যেখানে ইন্টারনেট দেয়া হচ্ছে সেখানে ব্রডব্যান্ড আছে কি না তাও যাচাই বাছাই করে দেখা হয়নি। তাছাড়া মোবাইল অপারেটরদের সক্ষমতা নেই যে তারা ব্রডব্যান্ডের মতো ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে। আর শিক্ষার জন্য ব্রডব্যান্ড দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই।
এই পদক্ষেপে ‘জাস্ট কতগুলো টাকার অপচয় হবে’ বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
মন্ত্রীর মতোই এই উদ্যোগ দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রসারে নেয়া সরকারি উদ্যোগকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষায়, শিক্ষার জন্য ‘ডাটা’ নির্ভরতা অনলাইন শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকেও একটি অপূর্ণ সীমায় আটকে দেবে। একইসঙ্গে ‘ওয়াইফাই’ সুবিধার নামে মোবাইল অপারেটর বনাম ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সেবার নামে নতুন বিরোধ সৃষ্টি করবে এবং গ্রাহকদের মধ্যে ইন্টারনেট ‘ডাটা’ বাণিজ্য নিয়ে বিদ্যমান অসন্তোষের পাল্লাকে আরো ভারী করবে।
বিষয়টি সরকারী নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক। তিনি জানান, জ্ঞান ভিত্তিক ও ডিজিটাল অর্থনীতি নির্ভর উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রসারকে যখন সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন গত বছর ১ নভেম্বর কেবল মোবাইল অপারেটরদের জন্য এই সেবা দেয়ার পথ উন্মুক্ত রেখে দরপত্র দিয়েছিলো প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর, মিরপুর-২। বিষয়টি সংশোধনে সংগঠনের পক্ষ থেকে কেবল সিম কার্ডের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে দরপত্রের কারিগরি শর্তগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধনী বিষয়ে চিঠি দেয়া হলেও তারা তা আমলে নেয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।
ইমদাদুল হক বলেন, যেসব জায়গার জন্য টেন্ডার দেয়া হয়েছে সেসব স্থানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা থাকার পরও দরপত্রে অসম শর্ত বেধে দিয়ে আমাদের এতে অংশগ্রহণ করার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে আমরা চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমকে বাধাহীন রাখতে আমরা আনলিমিটেড ব্যান্ডউইথ দেয়ার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা আমলে নেয়া হয়নি।
গত বছর ১৫ নভেম্বর আইএসপিএবি’র পক্ষ থেকে শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকিউরমেন্ট বিভাগের পরিচালক বরাবর দেয়া এ সংক্রান্ত চিঠিতে সুস্পষ্ট যুক্তি তুলে ধরে দরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনগুলো সীমাবদ্ধতা ও অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরে তা পরিবর্তনে করণীয় বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এতে সংযোগ এর ক্ষেত্রে সিম এর সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ জুড়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও সেবাটি যেনো মোবাইল অপারেটররা ছাড়াও বিটিআরসি’র লাইসেন্স প্রাপ্ত ন্যাশন ওয়াইড সার্ভিস প্রোভাইডারদের অন্তর্ভূক্ত করা হয় সেই দাবি করা হয়েছে। একইভাবে শুধুমাত্র ৪জি প্রযুক্তির বদলে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড যোগ করে ইন্টারনেটের উচ্চ গতির বিষয়টিও এখানে তুলে ধরা হয়েছে।