ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেইফবর্ডার প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৪ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে ১১ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস (এসআইডি) পালন করে শতাধিক দেশ। তবে এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেইফার ইন্টারনেট ডে বা সিড এর সদস্যভুক্ত না হওয়ায় রাষ্ট্রীয় বা বাণিজ্যিক ভাবে দিনটি আলাদা ভাবে পালন করা হচ্ছে না। অবশ্য আইসিটি বিভাগ ও ইউনিসেফ এ নিয়ে আইসিটি টাওয়ারে একটি অনুষ্ঠান করেছে।
যদিও বছর দুয়েক ধরে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ চালু করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, যারা এই নির্দেশনা মানবে না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। অপরদিকে নিয়ন্ত্রকসংস্থা বিটিআরসি’র মাধ্যমে নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে কাজ করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি। সম্প্রতি ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে ‘সত্য মিথ্যা যাচাই আগে ইন্টারনেটে শেয়ার পরে’ ডাক দেয় আইসিটি বিভাগ।
তবে এসব উদ্যোগের সমান্তরাল ভাবে ‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারী’দের মধ্যে ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানো ও সচেতন করার প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল নিশ্চিত করতে হলে আইএসপি বা মোবাইল অপারেটর নয়, আইআইজি কোম্পানিগুলো-কেই এ বিষয়ে চাপ দিতে হবে। আর আইসপি ও অপারেটরদের নিয়ে সরকার প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তুলবে।
এ নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ ইন্টারনেট দিবসটি অতীতেও আমাদের দেশে পালিত হয়নি। এটা যারা করছে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি আন্তর্জাতিক বা আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবেও পড়ে না। আমরা আইটিইউ, জিএসএম এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে তাদের দিবসগুলো পালন করি। তবে দিবস ছাড়াই আমরা ইন্টারনেট-কে নিরাপদ করতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল নীতিমালা করেছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিসহ যেই এজেন্সিই ইন্টারনেটে হুমকী নিয়ে আমাদের বলে বিটিআরসি তা প্রতিপালন করতে অপারেটর ও আইএসপি-কে নির্দেশনা দেয়। আর এক্ষেত্রে সচেতনতা গড়ে তুলতে সকলকেই সোচ্চার থাকতে হবে। গত দুই বছর ধরে আমি ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ে আসছি। এটা অব্যাহত আছে।
মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কে দেশে এই মুহূর্তে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই ৪০ বছরের কম বয়সী। আবার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪১ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সময় কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে ১১ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত হচ্ছে। আর এই জায়গাটিতে মোবাইল অপারেটররা এগিয়ে থাকলেও তারা এখনো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতিগত জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অবঃ) বলেন, “নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের নিশ্চয়তায় অপেরাটররা সার্বক্ষনিকভাবে বিটিআরসির সাথে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় অপারেটরগন ইতোমধ্যেই বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী বেশকিছু সাইট এবং কনটেন্ট ব্লক করেছে। এছাড়াও ইন্টারনেটে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সংক্রান্ত যে নির্দেশনা বিটিআরসি প্রদান করেছিল তা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় অপারেটররা বিটিআরসির সাথে পরামর্শের আবেদন করেছে। বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার পরে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।”
সূত্রমতে, নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতারা ইতিমধ্যেই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার শুরু করেছেন। এ বিষয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক সংগঠন আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, আইএসপিএবি’র সদস্যভুক্ত ৭০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাড়ে ৫০০ সদস্য প্যারেন্টাল কন্ট্রোল প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছে। বাকীগুলো আগামী দুই মাসের মধ্যে তাদের নেটওয়ার্কে এই সল্যুশনটি ব্যবহার করবে। প্রত্যেকটি আইএসপি কোম্পানি নিজ উদ্যোগ থেকেই গ্রাহকদের সচেতন করছে।
এ বিষয়ে দেশের অন্যতম ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আইসিসি কমিউনিকেশনস লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক বলেন, লাস্টমাইল পর্যন্ত ইন্টারনেট সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখতে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় মোস্তাফা জব্বারের নির্দেশনা অনুযায়ী আরঅ্যান্ডডি’র মাধ্যমে আমরা আমাদের নেটওয়ার্কে ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সুবিধা চালু করেছি। সংযোগ দেয়ার সময় বিষয়টি অভিভাবকদের অবগত করছি। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই এ অভিযাত্রায় সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে সরকার ও অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি ‘ইউনিফর্ম প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।
অপরদিকে মোবাইল অপারেটর গ্রামীণ ফোনের হেড অব কমিউনিকেশন খায়রুল বাশার জানান, গ্রামীণফোনের ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এ জন্য আমরা ইউনিসেফের মাধ্যমে সারাদেশে সচেতনতা গড়ে তুলছি। চলতি বছরের মধ্যে ১২ লাখ শিক্ষার্থীকে সচেতন করার কার্যক্রম পালন করছি। তারপরও এখানে সচেতনতার একটি বড় শুন্যতা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. জাকির হোসেন খান বলেন, আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই তাদের নেটওয়ার্কে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার শুরু করেছেন। তবে মোবাইল অপারেটররা কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতার কথা বলে আলোচনার আবেদন করেছে। আশা করছি, ‘স্বল্পতম’ সময়ের মধ্যে সমস্যার সুরাহা হবে।