রবিবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে নতুন বাংলা বছর ১৪৩১। ষড় ঋতুর এই দেশে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার দিন থেকে শুরু হওয়া ফসলি সন; তথা নববর্ষ বিবর্তীত হয়েছে বঙ্গাব্দে। এরপর প্রযুক্তির বিবর্তনে লাল সালুতে মোড়ানো ‘হালখাতা’ও আজ অপসৃত প্রায়। কম্পিউটিং প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানের হিসাব আনুষ্ঠানিক হালনাগাদের এ প্রক্রিয়াও ভাটা পড়েছে।
এক সময়ে বছর শুরুর দিন ভোরে দোকানপাট ধুঁয়ে, সোনা-রূপার পানি ও গোলাপ জল ছিটানো হতো। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই বকেয়া রয়েছে এমন ক্রেতাদের কাছে হালখাতার দাওয়াত কার্ড পাঠানো হতো। এছাড়া লাল কাপড়ে মোড়ানো বা বাঁধাই করা মোটা খাতা তথা টালিখাতা/হালখাতা ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করতো। তবে এই হালখাতার জায়গায় এখন প্রতিস্থাপিত হয়েছে কম্পিউটিং প্রযুক্তির ইআরপি সফটওয়্যার। ঐতিহ্য মেনে কোথাও কোথাও হালখাতা হলেও হিসাবটা আর এখন খাতায় নয় থাকে কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোনেই। অর্থ বছরের পাশাপাশি কেউ কেউ যদি হালখাতা করেন তবে ক্রেতারা আগের মতো সাড়া দেন না। মিষ্টিমুখ কিংবা দোকান সাজিয়ে বাকি আদায়ের সেই রেওয়াজ এখন আমাদের অতীত। এরপরও কেউ যদি সেই বকেয়া পাওনার হিসাব পাঠান তকে ব্যাংক ট্রান্সফার কিংবা বিকাশ-নগদ এর মতো এমএফএস মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন পাওনাদাররা।
একটা সময় ছিল যখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালিত হতো ‘আর্তব উৎসব’ তথা ‘ঋতুধর্মী উৎসব’ হিসেবে। ফসল উত্তোলন গণনায় একসময় বিপর্যস্ত হয়েছিল মুঘল আমলের ফসলি হিসাব। অনিয়মতান্ত্রিক খাজনা পরিশোধের গরমিলে পড়ে যেত বাংলার কৃষক। তাই প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর। আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি ‘সৌর সন’ এবং আরবি ‘হিজরি সন’ এর ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।
মুদি খানা থেকে করপোরেট সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এখন হিসাব রাখা হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। খাতার কাজ এখন কম্পিউটার কিংবা মোবাইলফোন। আগে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতাদের হাতে লেখা টালি (স্লিপ) দেওয়া হতো। এখন কম্পিউটারাইজড স্লিপ দেওয়া হয়। ফলে খাতা রাখার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। অবশ্য দেশের ব্যবসায় জগতে ‘টালি’ নামটি এখনো বেশ পরিচিত হয়ে আছে এই নামের (ট্যালি) ইআরপি ও সিআরএম সফটওয়্যারের কল্যাণে। মুদি দোকানগুলোতে হরহামেশা ব্যাবহৃত হয় ‘হিসাবপাতি’ ও ‘মোকা ‘ কিংবা ‘শপআপ রিটেইল’ এর মতো জনপ্রিয় অ্যাপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা কিউআর কোড। চা দোকান, মুদি দোকান, হোটেল, মুচিসহ ভাসমান বিক্রেতাদের কাছে হালে এই প্রযুক্তিটি হিসাব-পাতিতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, দোকানে কম্পিউটার না থাকলেও মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাপড় কিংবা কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটিও দিন দিনই উধাও হতে চলেছে। কাস্টমাইজ অ্যাপ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় হিসাবের জন্য। এছাড়াও হিসাব জানাতে এখন আর কার্ড না ছাপিয়ে এসএমএস, ই-মেইলে, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো-তে হিসাব-পাওনা জানানো হয় প্রতি প্রান্তিকে। এজন্য পুরো বছর অপেক্ষা করা হয় না এখন। তিন কিংবা চার মাস পর পরই হিসাব জানিয়ে দেয়া হয় প্রয়োজন হলে। মূলতঃ প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতি লেনদেনের সঙ্গেই হালনাগাদ হয়ে যায় ব্যবসায়িক হিসাব। যদি বকেয়ে বেশি হয়ে যায় তখনই পাঠানো হয় পাওনার তাগাদা। বিশেষ করে ঈদের আগেই এই হিসাব ক্লোজ করার চেষ্টা করেন খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
ডিজিটাল বাংলাদেশে তাই কম্পিউটার, মোবাইল, সফটওয়্যার, কাস্পমাইজড অ্যাপ এবং অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে একাকার হয়ে গেছে নববর্ষের ‘হালখাতা’। তারপরও রাজধানীর তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার ও ইসলামপুর এলাকার ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর হালখাতার মাধ্যমে নতুন হিসাব শুরু করেন। অর্থাৎ জুয়েলারির মালিকরা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন এই ঐতিহ্য।