মোস্তাফা জব্বার
ছিচল্লিশ বছর আগে বাংলার মাটিকে রক্ত দিয়ে পবিত্র করে যাকে সপরিবারে শহীদ হতে হয়েছিলো তাঁর সম্পর্কে দুটি বাক্য লিখতে কার অনুভূতি কি হয় জানিনা, আমারতো অন্তর কাঁপে। আমি অক্ষর হারিয়ে ফেলি-বাক্য পূর্ণ করতে পারি না। আবেগ অনুভূতির প্লাবন বয়ে যায়। কোনভাবেই আমি তাকে নিয়ে লেখার সাহস পাইনাই। এতো বড় মাপের মানুষ তাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার মতো নগন্য একজনের থাকতেই পারে না বলে আমি মনে করি। আমি তার ভক্ত-সৈনিক।
আমার চারপাশে কিংবা ইতিহাসের পাতায় তাঁর সাথে তূলনীয় কোন রাজনীতিককে আমি দেখি না। বাংলাদেশতো দূরের কথা, সারা দুনিয়াতেই তিনি একজনই। তিনি কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী নন। তাকে আমি মনে করি একজনই বাঙালী, যার মাঝে বাঙালীত্বের পুরোটা আছে এবং সেজন্য তিনি সকল বাঙালীর, সকল বাংলা ভাষাভাষীর অনুসরণীয়, অনুকরণীয় এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। চারপাশে তাকে নিয়ে কোটি কোটি হরফ দেখি।
খণ্ড খণ্ড বই লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। যিনি যেভাবে চান তাকে সেভাবেই তিনি তাকে উপস্থাপন করছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে তার নীতি, আদর্শ বা কর্মপন্থাকে আমরা এখনও সেইভাবে মূল্যায়ন করিনা যেভাবে সেটি করা দরকার। অনেক ভাবনা থেকে তার সম্পর্কে একটি ছোট নিবন্ধ লেখার সাহসও এতোদিন পাইনি।
এবার যখন ৭২ বছর পার করেছি তখন মনে হলো এই মহামানব সম্পর্কে নিজের ভাবনাটা প্রকাশ করে যাওয়াটা নিজের কাছে জবাবদিহি করার মতো একটি বিষয় হতে পারে। নইলে এক সময়ে মনে হবে আমি তাকে যেমনটি ভাবি সেটিতো কাউকে বলিনি। মনে মনে ভাবছি যদি সময় পাই তবে আমি তাকে একটু বিস্তারিতভাবেই মূল্যায়ন করবো। গত তিন বছরে সেই চেষ্টাও করেছি। তাঁর বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা আমি করেছি। সেগুলো বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিতও হয়েছে। ইচ্ছা আছে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করার।
তাঁর নাম শুনেছি ৬৬ সালে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করি। সেখানেই ছয় দফা নামক একটি লিফলেট বিলাতে গিয়ে প্রথম জেনেছি যে বাঙালীরা তাদের প্রাপ্য পায় না। তার আগে সারাটা স্কুল জীবনে পাক সার জমিন সাদ বাদ গাওয়াইয়ে পাকিস্তানী বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৬৫ সাল ছিলো প্রথম যখন ঢাকা শহরে এসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কুশ পুত্তলিকা জ্বালাতে দেখেছি। ৬৬ সালে ৬ দফা পাঠ করে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, আমি বাঙালী এবং আমার একটি আলাদা অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, একটি আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা ভূখণ্ড রয়েছে। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুনলাম, বাঙালীদের একজনই নেতা তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ১১ দফায় সেই ছয় দফা যুক্ত হয় আর রাজপথে তার মুক্তির দাবিতে মিছিল করা দিয়ে নিজের শ্লোগান দেবার ক্ষমতাকে শাণিত করি। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগন্য একজন কর্মী হিসেবে তাঁর সামনে যাবার কোন কারণই ছিলো না। তবে যারা তাঁর কাছে থাকতেন তাদের সাথে আমরা দিন-রাত কাটাতাম বলে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা-জীবনাচার বা রাজনৈতিক দর্শন জানতে পারতাম। তাঁর জেষ্ঠ্য কণঅ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কয়েকমাস ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও ধারনা পাই। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে ঢাকা কলেজ থেকে চিনতাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাজনীতির সাথে নাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ঘণিষ্টতাও তৈরি হয়। সেই মানুষটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর জীবন নিয়ে ইতিহাস লেখার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। অনেকে লিখেছেন, লিখবেন এবং সারা বিশ্ব তাকে নিয়ে গবেষণা করবে, বর্তমানের প্রেক্ষিতে এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে তার কন্যা বাংলার স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যেখানে স্থাপন করেছেন তাতে সারা বিশ্বকে জানতেই হবে, কে এই দেশের জনক এই শেখ মুজিবুর রহমান।
এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাহীন ঝুড়ির দেশ এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সামনে আদর্শ দেশ, এই রূপান্তরটাতো আমাদেরকে জানতেই হবে। । আমাদের এই দেশটির জনক প্রথম আমাকে আকৃষ্ট করেন তার অতি সাধারন জীবন যাপন, সহজ সরল অভিব্যক্তি এবং স্পষ্টবাদিতায়। একবাক্যে তার বাঙালীত্বে।
আমি স্মরণ করতে পারি বঙ্গবন্ধু কেবল তার রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এমনকি তাদের পারিবারিক তথ্যও মনে রাখতেন। সেই মানুষটির সাধারণ মূল্যায়ন যখন আমরা করি তখন কেবল তার বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রাধ্যান্য দিই। যে সময়ে ব্রিটিশরা পুরা উপমহাদেশটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলঙ্কিত করে দুটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো এবং পুরো উপ মহাদেশের তাবত বড় বড় রাজনীতিবিদরা সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। তখন তিনি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেন। ভাবা যায় যে, পাকিস্তান তৈরির ৫ মাসের মাঝে জিন্নার মুখের ওপর কেউ না না চিৎকার করে নিজের মাতৃভাষার দাবিকে উত্থাপন করতে পারেন। এই অঞ্চলে ভাষারাষ্ট্র ধারনা তখন মোটেই গুরুত্ব পায়নি। ভারত বহুভাষিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। খুব সঙ্গত কারণেই ভারতের ধর্ম রাষ্ট্র হবারও খুব সুযোগ ছিলো না। তবুও ব্রিটিশরা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছিলো। ভারতের নেতারাও সেটি প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান হয়ে ওঠে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু সেই মানুষটি যিনি বাংলাদেশের অন্তরকে অনুভব করেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাঙালী যে তাঁর ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সবার ওপরে ঠাই দেয় এবং তার এই জীবনধারায় ধর্ম যে কেবল ব্যক্তিগত বিষয় এবং রাষ্ট্রের রাজনীতির প্রধান শক্তি নয় সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আমি নিজে অভিভূত হই যখন দেখি যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে থেকে তাঁর রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উপড়ে ফেলে দিতে পেরেছিলেন। যে মানুষটি নিজেকে স্পষ্ট করে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারেন যে তিনি বাঙালী, মানুষ এবং তারপরে মুসলমান, কেবল সেই মানুষটিই পাকিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের চোখের সামনে পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে ধর্ম নিরপেক্ষ করতে পারেন!
আজ তার মৃত্যুর ৪৬ বছর পর আমাদের আইন মন্ত্রীকে বলতে হয় যে, আমরা অবশ্যই ৭২ সালের সংবিধানে ফেরৎ যাবো। তিনি নিজেই অনুভব করেন যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমরা ফেরৎ যেতে পারিনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা দেশটিকে যেভাবে পাকিস্তানের দূরবর্তী অঙ্গরাজ্য বানিয়েছিলো, সেটির সংবিধান আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো করে ফিরে পেতে পারিনি। ভাবুন দেখি, তিনি তার দলের নাম থেকে কেবল মুসলিম শব্দ বর্জন করেননি, মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে টুকরো করে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আমার জানা মতে, তার হাতে তৈরি ৭২ সালের সংবিধানটি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংবিধান যার সাথে তুলনা করার মতো কোন সংবিধান অন্তত এই অঞ্চলে পাওয়া যায়না। এই সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে জিয়া ও এরশাদ কেবল যে সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করে তাই নয় এর গণতান্ত্রিক চরিত্রও বিনষ্ট করে। আমাদের জন্য দুঃখজনক যে ৭৫ থেকে ৯৬ অবধি দেশে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গড়ে তোলা হয় যে বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেও এখন ৭২-এর সংবিধানের পরিপূর্ণ মূল চরিত্রে ফেরৎ যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। এখন যদি তিনি সেই কাজটি করেন তবে রাজনীতির ছকটাকে উল্টানোর অপচেষ্টা করা হবে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী ও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনীতি প্রবলভাবে জোরদার করা হবে। সংবিধানকে নিয়েই মুসলিম আবেগ জোরদার করা হবে এবং এরজন্য যতো রকমের ষড়যন্ত্র করা যায় সেটি করাই হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর সময়কালের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর বিরাজ করেনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ দুর্বল হবার পর পুঁজিবাদের একতরফা বিকাশ, চীনের আপোষকামিতা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হুবহু যেতে পারছিনা।
আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে বুঝবেন না যেভাবে আমরা তাকে চিনি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালীত্ব, তার প্রতি একনিষ্ঠতা এবং জাতিস্বত্ত্বা বিষয়ে অত্যন্ত ষ্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখো লাখো তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা এখন মনে করেন যে, পাকিস্তান আমাদেরকে ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি এবং বনিবনা হয়নি বলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে পুরোটা বুঝতেই পারেন না।
কোন সন্দেহ নাই যে, তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনভাবে গড়ে তুলেন যে সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এটি প্রমাণ করেছি যে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ৪৮ সালেই তিন এটি বুঝেছিলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালীদের নয় এবং বাঙালীদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াই-এর প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন। তিনি একদিকে নির্বাচন করেছেন, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠে বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেই শ্লোগানও তুলে দিয়েছেন। বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তার তৈরি করা ৭২-এর সংবিধান বুঝতে হবে।
তাঁর ৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিলো চারটি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপক্ষেতা ও জাতীয়তাবাদ। ধীরে ধীরে আমরা সেই চার নীতির গণতন্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোকেই এড়িয়ে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করেনা। কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই।
হয়তো কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী গরীবের বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র ও তার ধারনা কাজে লাগানো ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়ে কায়িকশ্রম নির্ভর মালিক শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধাশ্রম ভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণিচরিত্র বা শ্রেণি সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে।
কোন এক মার্ক্সকে নতুন করে সমাজতন্ত্রের কথা বর্ণনা করতে হবে-ব্যাখ্যা করতে হবে মালিক-শ্রমিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা। শিল্পযুগের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের ব্যবস্থা শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ স্তরে চলতে পারেনা। অন্যদিকে পুজিবাদের রূপান্তরে তার মূল্যায়নও অন্যভাবেই করতে হবে। চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও পুজিবাদের ধারনাকে ভিন্নভাবে প্রয়োগ করে নতুন রাষ্ট্রীয় পুজিবাদের ধারনা তুলে ধরেছে। তবে সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যহীনতার ধারনাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেনা। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশকে আবার লড়াই করতে হচ্ছে।
জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধর্ম পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষেতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাড় করিয়েছে। একই কারণে বাঙালীর জাতিস্বত্ত্বা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণরা ইসলামি জঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকেতো বটেই পুরো বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানীরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়। আমরা পাকিস্তানীদের পরাজিত করে এর জবাব দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার অনন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যে মুজিব অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার আগেই বলেছিলেন, ভুল হোক শুদ্ধ হোক আমরা সরকারি কাজে বাংলাই লিখবো। কালক্রমে জিয়া এরশাদ ও খালেদা সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সরানোর চেষ্টা করেছে। ভাষার কথাই বলি।
বাংলাদেশের বেসরকারি অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে বাংলা ভাষা বিরাজ করে। কিন্তু যখনই আমরা এর ডিজিটাল রূপান্তর করছি, তখন বাংলা অবহেলার বিষয় হয়ে ওঠছে। বস্তুত ডিজিটাল করার নামে বাংলা হরফকে অনেক ক্ষেত্রেই বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চ শিক্ষায় বাংলা নেই। যে মানুষটি ৫২ সালে চীনে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ দেন এবং যিনি সদ্যজাত দেশের পক্ষে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল বলছে, ফেসবুকে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ বাঙালী বাংলা ব্যবহার করে। কী ভয়ংকর একটি চিত্র এতে প্রকাশিত হয়। আমি চাইনা আমার অনুমান সত্য হোক, কিন্তু মনে হচ্ছে এক সময়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা গ্রামের মানুষ ছাড়া বাংলা হরফই আমরা দেখবোনা। আপনি চারপাশে খোজ নিলেই দেখবেন, তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করেনা। এই হীনমন্য জাতির ভবিষ্যৎ কি? যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখানে থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি সেটি আমি মোটেই বুঝিনা। আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষারাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সকল ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালীকেই অনুসরণ করি যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : বিজয় বাংলার উদ্ভাবক; মন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ