বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হবে অর্থনৈতিক শক্তির আধার। একারণে একজন বিজ্ঞানীকে শিক্ষা নীতির দায়িত্ব দিয়ে আইটিইউ এর সদস্য পদগ্রহণ করেন। তখনই তিনি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে স্বাধীনতার ৫৪তম দিবসে মঙ্গরবার (২৬ মার্চ) রাষ্ট্রায়াত্ব টেলিকম অপারেটর টেলিটক এর সঙ্গে বৈশ্বিক বেসরকারি অপারেটর বাংলালিংক এর অ্যক্টিভ নেটওয়ার্ক শেয়ারিং এর পাইলট প্রকল্প উদ্বোধন করলেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দ্রুততম সময়ে ন্যাশনাল রোমিং সেবা চালু করায় বিটিআরসি চেয়ারম্যান ও তার টিমকে ধন্যবাদ জানান প্রতিমন্ত্রী।
পলক বলেন, গত এক মাসে আমি রোমিং চালু করেছি। আমার অভিজ্ঞতা ভালো। সেই অভিজ্ঞতার পর আজ উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ২ হাজার গ্রাহককে এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আপেক্ষায় আছে আরো ৮ হাজার গ্রাহক। সফল পরীক্ষার পর আগামী সেপ্টেম্বরে ন্যাশনাল রোমিং চালু করা হবে। এভাবেই আমরা গিগ অর্থনীতিতে এগিয়ে যেতে পারবো।
‘অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত টেলিটক’ এর সমস্যার সমাধানের পথ সহজ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমরা যদি একটু আন্তরিক, কৌশলী এবং অংশীদারিত্বের সুযোগ তৈরি করলে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করে লাভজনকে পরিণত করতে সক্ষম হবো। সেই লক্ষ্যেই ডাক বিভাগের সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকািরি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করবো। আমরা কারো প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবো।
টেলিটক-বাংলালিংক রোমিং সেবার নিয়ে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, টেলিটকের ৬ হাজার এবং বাংলালিংক এর ১৪ হাজার টাওয়ার মিলে এখন গ্রাহকরা ২০ হাজার টাওয়ার থেকে সেবা পাবে। বাংলালিংকের গ্রাহকরা এখন সুন্দরবন কিংবা বান্দরবনে টেলিটক এর নেটওয়ার্ক যেমন ব্যবহার করতে পারবে; টেলিটক গ্রাহকরা যেখানেই টেলিটকের নেটওয়ার্ক কম সেখানে উন্নত সেবা পাবে। এতে উভয় পক্ষই উপকৃত হবেন।
প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, ৫২ বছর আগে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই হবে আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। শিক্ষাই হবে অর্থনীতি, সামাজিক ও সংস্কৃতিক মুক্তির অন্যাতম হাতিয়ার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই আদর্শ ও চেতনা থেকে সম্পূর্ণ উল্টোপথে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক এবং অবিচ্ছেদ্য। এই তিনটি ইস্যুতে রাজনীতিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়িক নেতা, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, উদ্যোক্তা সকলেরই মধ্যেই এ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো সঙ্কোচ বা দ্বিধা থাকা উচিত নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
বক্তব্যে নিজেদের মধ্যে সম্পদ শেয়ারিং এর মাধ্যমে টেলিটক, বিটিসিএল, টেশিস ও ডাককে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন জুনাইদ আহমেদ পলক। জানালেন, অচিরেই টেলিটক ও ডাককে আগারগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। একইসঙ্গে সংস্থার অসৎ ও অলস কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলালিংক এর কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যাফেয়ার্স তৈমুর রহমানের অনুরাধে অনুষ্ঠানে প্রথম বারের মতো স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি আবৃত্তি করেন পলক। অনুষ্ঠান শেষে তৈমুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, পাইলট প্রকল্পে রোমিং এর জন্য কোনো খরচ গুনতে হবে না।
তবে পরীক্ষা মূলক এর পর যৌক্তিক মূল্য ধার্য করা হবে এবং শুরুতে টেলিটক দিয়ে শুরু হলেও আগামী সপ্তাহ খানেকের মধ্যেও বাংলালিংক গ্রাহকরাও এই রোমিং সেবা পাবেন বলে জানান তিনি।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারের বিসিসি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এস এম জাফর উল্যাহ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিসিসি নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আধুনিক রূপ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। বলেছেন, গত দেড় দশকে সব মানুষের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘাটানো হয়েছে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, তথ্য প্রযুক্তি সচিব সামসুল আরেফিন, বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড চেয়ারম্যান ডঃ শাহজাহান মাহমুদ, বাংলালিংক সিইও এরিক অস ও টেলিটক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান।
টেলিকম সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, ৫ হাজার বছরের মধ্যে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও পরিচালনা করেছেন। শশাঙ্ক থেকে সিরাজ উদ্দিন কেউই বাঙালী ছিলেন না। তারা জাতিরাষ্ট্র কিংবা জনগণের আকাঙ্খাকে ধারণ করেননি। সম্ভবত তার জন্ম না হলে আজ বাংলাদেশ হতো না। সে কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙলী।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব সামসুল আরেফিন বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বনির্ভরতা আর্জনে আমরা তথ্য প্রযুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাছি। বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন নতুন উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও স্টার্টআপ ইকো সিস্টেম গড়ে তুলছি।
এসময় বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদিইদন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন আর সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘটনাটি তেমন নয়। ৫৪ সালের যুক্তফন্টের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু সর্ব কনিষ্ঠ মন্ত্রী হয়েছিলেন। জেল থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়েও ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ৬৬ সালের ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। তিনি সাধারণ মানুষের আস্থায় নিয়ে অবিসংবাদিত নেতা হয়েছে। সারা বাঙালী তার ওপর আস্থা রেখিছিলো। ৭০ এর নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন। জাতির পিতা এমন একজন নেতা ছিলেন যে তিনি বুঝতেন কখন কী করতে হবে। তিনি ঠিক মুহূর্তেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যুদ্ধ করলেই স্বাধীন হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী, স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারলেই স্বাধীনতা অর্থবহ হবে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড চেয়ারম্যান ডঃ শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু জীবনী দেখলে দেখা যায় সারাটা জীবন বাঙালীর মুক্তির চিন্তা করেছেন। তার সারাজীবনের চিন্তা ছিলো জনগণ তথা বাঙালীর উপকারের জন্য। বাঙালীর মুক্তির জন্য তার আন্দোলনগুলোই তাকে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক হয়েছেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলালিংক সিইও এরিক অস বলেন, ২৩ বছর আগে আমি বাংলাদেশে এসেছি। আমি এই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমি মনে করি আমি এই দেশের উন্নয়নের একজন অংশীদার। গত ১৫ বছরে আমি এই দেশের দারুণ উন্নয়ন দেখেছি। দেখেছি মানুষের চমৎকার মানসিকতা ও খুবেই যোগ্য নেতৃত্ব। প্রতিবছরই আমি এই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি নিরক্ষরাতা হ্রাস, অবকাঠামো উন্নয়নকে বেঞ্চ মার্ক হিসেবে দেখছি। আজ টেলিটক এর সঙ্গে বাংলালিংক এর আবকাঠামো ভাগাভাগি হচ্ছে মানেই দুইটি কোম্পানি এক হয়ে যাচ্ছে না। এর অর্থ, গ্রাহক সেবায় দুই প্রতিষ্ঠানই প্রয়োজনে উভয়ের পাশে থাকছে।
টেলিটক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর জন্য আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তার কারণেই আজকের দিনটি টেলিটক এর জন্য বিশেষ বৈশিষ্টমন্ডিত দিন। আজ বাংলালিংক আমাদের জন্য তাদের নেটওয়ার্ক শেয়ারিং করার আনুষ্ঠানিক সুযোগ দেবে। আমরা আশা করছি পাইলট প্রকল্পটি সফল হলে টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ সাশ্রয় হবে। একই সাথে গ্রাহকও উন্নত সেবা পাবে। টেলিযোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছি।