ব্র্যাক ব্যাংকে থাকা টাকা নিয়ে মামলা চলছে উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের মধ্যে। মামলার জেরে এই টাকা লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এরই মধ্যে উল্কা গেমসের কর ফাঁকির ৫০ কোটি টাকা আদায়ে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি টিম। তবে ১৩ ঘণ্টার অভিযান শেষে টাকা ফেরত নিতে না পারার লিখিত ব্যাখ্যা নিয়ে গুলশান শাখা ত্যাগ করেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, কর অঞ্চল-১৫ এর ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে দুপুর ১২টা থেকে রাত পর্যন্ত একটি বিশেষ টিম ব্র্যাক ব্যাংকের ওই শাখায় অভিযান শুরু করে। রাত ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ব্যাংকের ওই শাখায় এনবিআর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে আদালতের আদেশ থাকায় ব্যাংক থেকে কর ফাঁকির এই টাকা আদায় করতে পারেননি ওই কর্মর্তারা।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখায় উল্কা গেমস লিমিটেডের নামে থাকা হিসাব ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ফ্রিজ করা ছিল। সিআইসির কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেতে পারে। সে কারণে হিসাব সচল করে টাকা আদায়ে কর অঞ্চল ১৫ কে নির্দেশনা দেয় সিআইসি। আদেশ পেয়ে গুলশান শাখায় যান কর্মকর্তারা। তবে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ প্রায় ১৩ ঘণ্টা ব্যাংকে অবস্থান করেও টাকা ছাড়াই শাখা ত্যাগ করতে বাধ্য হন কর কর্মকর্তারা। টাকা না পেলেও লিখিত ব্যাখ্যা নিয়ে যায় কর অঞ্চল-১৫ এর কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে এনবিআর মনে করছে— ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এমন আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অপরদিকে এনবিআর চেয়ারম্যানের লিখিত অনুমোদন নিয়ে অভিযানে যাওয়া এনবিআর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দাবি পাওনার সঙ্গে ওই মামলার কোনো যোগসাজশ নেই। করের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রসঙ্গত, উল্কা গেমস নামে একটি অনলাইন জুয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগে দুই বছর আগে তদন্ত শুরু করে এনবিআরের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইসি। টাকা নিয়ে কোম্পানিটি যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য উল্কা গেমসের ব্র্যাক ব্যাংকে থাকা ৫৩ কোটি টাকা ফ্রিজ করে সিআইসি। তদন্তে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ফাঁকির প্রমাণ মেলে।
এ নিয়ে কর অঞ্চল ১৫ এর উপকমিশনার ফারজানুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের সহযোগিতা করছে না। এই টাকা নেওয়া ছাড়া কোনো অপশন নাই। এই টাকা আমাদের নিতেই হবে।
ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজার হাসান মাহমুদ জানিয়ছেন, ব্যাংকে থাকা টাকা নিয়ে মামলা চলছে উল্কা গেমস ও ভারতীয় কোম্পানি মুনফ্রগের মধ্যে। মামলার জেরে এই টাকা লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এনবিআর এই টাকা পাবে কি না সে বিষয়ে শুনানি হবে ৫ মে। অর্থাৎ বিষয়টি বিচারাধীন ও আদালত অবমাননার ঝুঁকি থাকায় এনবিআরের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর গেইমিং ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের নামে ভুল তথ্য দিয়ে আইনি বৈধতা নেয়া উল্কা গেমস লিমিটেড দেশ থেকে বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে জানিয়েছিলো র্যাব। মহাখালী ও উত্তরা থেকে এই চক্রের মূল হোতা উল্কা গেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামিলুর রশিদসহ ছয়জনকে গ্রেফতারের পর তাদের দেয়া তথ্যের বরাতে র্যাব মুখপাত্র তখন জানিয়েছিলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশের কোটি কোটি টাকা সরিয়েছে উল্কা গেমস। গেমিং উন্নয়নের উদ্দেশে শুরু হলেও উল্কা গেমস তা না করে তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে টাকা সরায় প্রতিষ্ঠানটি।
র্যাব জানয়, উল্কা গেমসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জামিলুর রশিদের সঙ্গে ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে তিনি মুনফ্রগ ল্যাবের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখের বেশি টাকা বেতনে নিযুক্ত হন।
মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন জুয়া অ্যাপ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমটিকে আরও ছড়িয়ে দিতে দেশে বৈধতা নিতে আইনজীবীদের পরামর্শে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিরুল রশিদ ‘উল্কা গেমস প্রা. লি.’ নামে একটি গেমিং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেন।
পরে ২০১৯ সালে মুনফ্রগের শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ উল্কা গেমসকে দেয়ার মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকার মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেইমিং খাতে উন্নয়নের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা নেয়ার ব্যবস্থা করে।
তবে ২০২১ সালের মার্চে বাংলাদেশের উল্কা গেমস ও ভারতের মুনফ্রগ ল্যাবকে অধিগ্রহণ করেছে সুইডেনভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় গেমিং কোম্পানি স্টিলফ্রন্ট। তখন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্টিলফ্রন্ট গ্রুপ জানায়, ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে মুনফ্রগ ল্যাবের ৯১ শতাংশ শেয়ার এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি অংশ আগামী তিন বছরের মধ্যে কয়েকটি ধাপে পরিশোধ হবে।