উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় গণমাধ্যম কর্মীদের মতামত দিতে আগামী ১০ দিন সময় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এজন্য দ্রুততম কময়ে সংশোধিত খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে এবং সেখানেই ই-মেইলে মতামত দেয়া যাবে।
বুধবার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সম্মেলন কক্ষে প্রস্তাবিত ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ এর খসড়া বিষয়ে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সুপারিশ ও মতামত নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই আহ্বান জানান তিনি।
আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমের সভাপতিত্বে স্বগত বক্তব্যে আইসিটি বিভাগের আইন ও পলিসি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রঞ্জিৎ কুমার সরকার জানান, ২৪ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত অনলাইনে মাতামত নেয়া হয়েছে। তবে অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে মতামত নেয়া হচ্ছে। আপরাদের সুচিন্তিত মতামত আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে কাজে লাগবে।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশের তথ্য-উপাত্তের স্বাধীনতা ও সার্বোভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আইন করা হচ্ছে জানিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ডেটা হচ্ছে ওয়েল। অতি মূল্যবান সম্পদ। তাই একদিকে যেরকম ডেটা প্রাইভেসি প্রোটেকশন দরকার; অপরদিকে ডেটার একটা ক্লাসিফিকেশন দরকার যাতে অ্যানোনিমাস ডেটাগুলো আমরা বিভিন্ন বিজনেস কেইস ও সরকারের সেবায় ব্যবহার করতে পারি। অপরদিকে আমাদের কোনো বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানি যেনো আমাদের অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করতে না পারে। মূলতঃ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষন ও তথ্য-উপাত্তের স্বাধীনতা ও নিরপতত্তা নিশ্চিত করতেই এই আইনের প্রস্তাব করছি। কেননা আগামী পৃথিবীতে যারাই ডিজিটিাল ডেটা সংরক্ষণ করতে পারবে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে কাজে লাগাবে; তারাই হবে সম্পদশালী দেশ; সমৃদ্ধ জাতি।
সভার শুরুতেই খসড়া আইনের বিষয়ে উপস্থাপনা পেশ করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ বলেন, ‘এই আইনটি প্রোটেকশনের জন্য, কাউকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়। এজন্য ওয়েবসাইটে আইনে খসড়া প্রকাশের পর আইনটি যুগপৎ করতে আমরা সবার মতামত নিচ্ছি। এরই মধ্যে ২১টি রেসপন্স পেয়েছি। সর্বপ্রথম ১৭ জুলাই কুটনীতিকদের সঙ্গে এবং এরপর ১ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে মত বিনিময় করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকেও সুচিন্তিত মাতামত নিচ্ছি। এখানে আইনগত ব্যক্তিসত্বা, সংস্থা, অংশীদারি কারবার, কোম্পানি, সমিতি, কর্পোরেশন, সমবায় সমিতি, প্রতিষ্ঠান বা সংঘবদ্ধ সংস্থাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আর ডেটা সংরক্ষণ ও ক্রসবর্ডার ডেটার ক্ষেত্রে জিডিপিআর আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য না হওয়ায় ; আশিয়ানের ক্রস বর্ডার প্রাইভেসি রুলস আমলে নিচ্ছি। আইনি বিশ্লেষণে উত্তীর্ণ হলে তা গ্রহণ করবো।’
এরপর আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনার শুরুতেই সুরক্ষা আইনে ‘নিয়ন্ত্রণ’ বিধি বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীও একমত প্রকাশ করে বলেন, বিদেশী আইনে এই ‘কন্ট্রোল’ শব্দ রয়েছে। তাবে আমরা আমাদের আইনের স্প্রিট ঠিক রাখতে এ ক্ষেত্রে ‘ব্যবস্থাপনা’ বা ‘সমন্বয়’ ব্যবহার করতে পারি। শব্দ ব্যবহারে আরো উদার হয়ে নিয়ন্ত্রকের জায়গায় ব্যবস্থাপক দিতে পারি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এখানে যদি নিয়ন্ত্রকের জায়গায় ব্যবস্থাপক প্রতিস্থাপন করা হয়, কন্ট্রোনালের জায়গায় ম্যানেজার দেয়া হয় আইনগত ভাবে সমস্যা না থাকলে আমরা এটি এক্সেপ্ট করতে পারি।
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্মতি ছাড়া তৃতীয় পক্ষের কাছে যেনো ডেটা না যায়; সেই সুরক্ষার জন্য এই আইন করার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। সেই ধারাবহিকতায় এরপর ডেটা বিজ্ঞানী ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে খসড়া আইন নিয়ে বৈঠক করা হবে।
আইনটি ‘ক্রস বার্ডার এজেন্ডা’ উল্লেখ করে এই আইন তৈরিতে অন্য দেশের আইন অনুকরণ করা হচ্ছে না। এখানে আমরা জিডিপিআর অনুসরণ করছি না। আশিয়ান ক্রেস বর্ডার ডেটা প্রোটেকশন রুলস অনুসরণ করছি। কেননা, এটা নির্দিষ্ট দেশের জন্য করা হয়নি। পাশাপাশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে নিয়ে সম্মিলিত ভাবে কাজ করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডেটার নিরাপত্তা সহ সাইবার সুরক্ষা বিষয়ক যে কোনো পরামর্শ পেতে ৩৩৩ তে ফোন করার পরামর্শ দেন জুনাইদ আহমেদ পলক।
উন্মুক্ত আলোচনায় ডেটা সুরক্ষায় ‘স্বাধীন কমিশন’ গঠনের পরামর্শ দেন এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু। তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় গেলে তারা জোর করে আমাদের থাম্ব প্রিন্ট নেয়। সেটা বিভিন্ন জায়গায় যায়। আজ এতো স্মার্ট প্রিন্টার আছে যা দিয়ে ওই থাম্বপ্রিন্ট স্ক্যান করে স্ট্যাম্পে দিয়ে আমার জমি-জমা সব নিয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের প্রোটেক্ট করার জন্য আপনি একটা কমিশন করেন। যেখানে গিয়ে আমি আমার তথ্যে সুরক্ষা চেয়ে মামলা করতে পারবো। নির্বাচন কমিশন যখন ফিঙ্গার প্রিন্ট, আইরিশ এর মতো ‘বায়োমেট্রিক ডেটা নিচ্ছে’ তখন তা কীভাবে সুরক্ষিত থাককে তা আমরা জানি না। আবার সে তো আমাদের সম্মতিও নেয়নি। তাই সাধারণ মানুষের ডেটার সুরক্ষার জন্য আইন দরকার।
রাষ্ট্র ও সরকার এক নয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাক্ষসের ওপর খোক্কসদের রক্ষার জন্য যেনো এই আইন না হয়। এই যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আক্ট বিশ্বে আমাদের ভাবমর্যাদা নষ্ট করেছে। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে গুগল-অ্যামাজন ও মোবাইলে আসা অ্যাডসেন্স থেকে আমারা বুঝতে পারি আমাদের ব্যক্তি পছন্দ অপছেন্দের তথ্য ঠিকই অন্যের হাতে যাচ্ছে। তাই এ জন্য আইন তৈরির আগে ডাটা সুরক্ষার জন্য ‘ডাটা কমিশন’ করা উচিত। প্রয়োজন হলে এটা নির্বাচনের পর করা যেতে পারে।
এছাড়াও ভেটিংয়ের পর সংসদে যাওয়ার আগে সংশোধিত আইনে অংশীজনদের মত কতটুকু প্রাধান্য পেয়েছে তা মিলিয়ে নেয়ার জন্য সময় রাখার আহ্বান জানান বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, আমরা সবার জন্য স্বস্তিকর অনুভূতি দিতে আমরা অংশীজনদের মত নিচ্ছে। আশা করছি, আইনটি হবে ‘প্রগ্রেসিভ’। তবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞেতা রয়েছে। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, খসড়া আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পর এবং পাশ হওয়ার আগে আবার যেনো এ বিষয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কেননা অংশীজনদের সামনে আইন যখন উপস্থাপন করা হয় তখন চমৎকার চতৎকার বিষয় থাকে। তবে এর প্রায়োগিক বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন প্রতিমন্ত্রী পলক। তিনি বলেন, আমরা নাগরিকদের জন্য এই আইন করছি। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়। তাই আজকে আলোচনা শেষে ‘নিয়ন্ত্রণ’, ‘নিয়ন্ত্রক’ ইত্যাদি শব্দকে পরিবর্তন করে ‘ব্যবস্থাপনা’ যুক্ত করে সংশোধিত খসড়া ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হবে। তা দেখে যে কেউ মতামত দিতে পারবে।
উন্মুক্ত আলোচনায় সংবাদিকদের দেয়া নানা পরামর্শের ওপর আইনিটির বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন আইসিটি বিভাগের আইন ও পালিসি অনুবিভাগের পরামর্শক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোঃ শহীদুল হক। সভায় টেকনোলজি মিডিয়া গিল্ড বাংলাদেশের (টিএমজিবি) সভাপতি মোঃ কাউছার উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোরসালিন জুনাইদ, ৭১ টিভির সিনিয়র রিপোর্টার রাকিবুল হাসান, ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার জাইমা ইসলাম, এনটিভি’র প্রধান বার্তা সম্পাদক জহিরুল আলম, কম্পিউটার বিচিত্রা সম্পাদক ভূঁইয়া মোহাম্মদ লেলিন প্রমুখ তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
বক্তব্যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য ডেটা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সুযোগ রাখা, দেশের বাইরে থেকে এই আইন ভাঙলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়, মোবাইল হারিয়ে গেলে খোয়া যাওয়া তথ্য সংরক্ষণ, অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য নেয়া ইত্যাদি বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট ধারা বা উপধারা অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব করা হয়। একইসঙ্গে খসড়া আইনের চতুর্দশ অধ্যায় এর প্রয়োজনীয়তা বা অভিসন্ধি নিয়ে নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এছাড়াও বিভিন্ন ধারায় শব্দ ব্যবহারে আরো যৌক্তিক পরিস্কার ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে আইসিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, ডেটার সুরক্ষা দিতে না পারলে আামাদের স্বধীনতা- সর্বোভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সে জন্য এই আইনের খসড়া করা হয়েছে। আজকের পর এটা কিছুটা পরিপূর্ণতা পাবে। আপনাদের মতামত সন্নিবেশ ঘটিয়েই এই আইন করা হবে। এতে সাইবার সিকিউরিটিতে বিশ্বে আমাদের যে ভালো অবস্থান রয়েছে তা আরো উন্নত হবে। আমরা চেষ্টা করবো জনবান্ধব ডাটা সুরক্ষা আইন করবো।
উন্মুক্ত এই আলোচনায় বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামে সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম ঢেউ, চ্যানেল আই এর চিফ নিউজ এডিটর (সিএনই) জাহিদ নেওয়াজ খান, নিউজ ২৪ এর নিউজ এডিটর শুভ অঙ্কুর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।