নিয়ন্ত্রণ নয়; সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই প্রণীত হবে ডেটা সুরাক্ষা আইন ২০২২। এজন্য আজকের পরও অংশীজনদের পরামর্শ গ্রহণ এবং তা বিলটিতে অন্তর্ভূক্তির পরামর্শ দিয়েছেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক। আর অংশীজনদের খসড়া আইন বিষয়ে মতামত চেয়ে ‘এই আইন ডেটার সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি এনে দেবে’ বলে মনে করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। অপরদিকে আইনটি স্বাধীনভাবে প্রয়োগে এ জন্য একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত সায়ত্বশাসিত কাঠামো চেয়েছেন টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।
রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২২’ নিয়ে অনুষ্ঠিত অংশীজনসভায় এমনটাই তুলে ধরেন বক্তারা।
আলোচনা শেষে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ দুই-তিনটি অংশীজন পরামর্শ সভা হবে। এরপর ডিসেম্বরে আইন হিসেবে সংসদে উপস্থাপন করা হবে এই ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২২’। উপাত্ত সুরক্ষা আইন যাতে সর্বজনীন হয় এবং বাংলাদেশের জনগণ যাতে এই আইনের মাধ্যমে পরিবর্তিত পৃথিবীকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারে তার উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ সভা করা হচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মঈনুল কবির।
এসময় জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমরা নিয়ন্ত্রণ নয়, নাগরিকের ডেটার সুরক্ষায় করছি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডেটার লোকাজাইশেন, ফাইন্যানশিয়াল ডেটা সনাক্তকরণ ও ক্রসবর্ডার ডেটা নিয়ে আরো কাজ করা হবে। এজন্য আমরা ডাটা বিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য অংশীজনদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, এই আইন নিয়ে জুলাই-আগস্ট মাসে আরও ২-৩টি পরামর্শ সভা করা হবে এবং এসব পরামর্শ সভার মাধ্যমে উঠে আসা যুক্তিসঙ্গত সুপারিশগুলো গ্রহণ করে সকলের জন্য মঙ্গলজনক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য আইন করা হবে। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের এবং রাষ্ট্রের তথ্যের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।
এক প্রশ্নের জাবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রের সুরক্ষা এবং তথ্যকে বাণিজ্যের স্বেচ্ছাচারি ব্যবহার রোধ করা হবে। ডেটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এর বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথও উন্মুক্ত হবে। ফেসবুক, টুইটারের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আইনের অধীনে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। ডেটা বিশ্লেষণ ও উদ্ভাবনার মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার আয়ের পথও সৃষ্টি হবে।
পলক আরো বলেন, ‘এখন ডাটাকে নতুন সম্পদ বলা হচ্ছে। যাদের যত বেশি তথ্য-উপাত্ত থাকছে তারা তত বেশি ধনী। কারণ সেই ডাটা গবেষণা করে তারা নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করতে পারছে। এটা এখন ট্রিলিয়ন ডলার মার্কেট প্রাইজ হয়ে যাচ্ছে।’
‘বিভিন্ন কোম্পানি ফ্রি সার্ভিস দিয়ে আমাদের তথ্য নিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই আমাদের ডাটা সংরক্ষণ আইন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে’- যোগ করেন পলক।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়, ‘এই আইন হলে আমাদের তথ্য-উপাত্ত বাণিজ্যিকভাবেও আমরা ব্যবহার করতে পারব। তখন অনুমতিসাপেক্ষে এই তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে পারব।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে আইসিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব নিয়াজ মোহাম্মাদ জিয়াউল আলম জানান, গত ২৪ মার্চ আইসিটি বিভাগের ওয়েবসাইটে ডাটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০২২ এর খসড়া প্রকাশ করার পর দেশের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও বেশি কিছু পরামর্শ এসেছে।
অংশীজন সভায় খসড়া আইনটি উপস্থাপন করেন আইন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোঃ শাহিদুল হক। এসময় তিনি জানান ১৯টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরামর্শ নিয়ে এই খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে গ্লোবাল ভিলেজ এ তথ্যের সার্বভৌমত্বে গুরুত্বারোপ করে ১৪টি অধ্যায়ে এই খসড়া বিলটি ৬৯টি ধারায় সাজানো হয়েছে এই আইনটি। কেননা আমরা বিশ্বস করি ডাটা আমাদের সম্পত্তি। তাই ডাটা সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় জিডিপিআর সহ আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়েছে।
খসড়া আইনের ওপর মুক্ত আলোচনা সঞ্চালনা করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আইডেন্টিটি চুরি, ডেটা থেফট ইত্যাদি বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এজন্য ডাটার সার্বভৌমত্ব ও ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক স্বকীয়তা রক্ষা এখন সময়ের দাবি। আর তাই জিডিপিআর-কে অনুসরণ করা হয়েছে।
আলোচনায় আরো অংশ নেন বাংলালিংক প্রতিনিধি আব্দুল মোমেন খান, জাতিসংঘ প্রতিনিধি ইওহেন সান, ইউরোপিয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি, মাস্টারকার্ড সিইও সৈয়দ কামাল, এফআইসিসিআই প্রতিনিধি আলাউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রণদা প্রসাদ সাহা,টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, অ্যাটকো’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল বাবু।
নাগরিকের ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর এবং রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল তথ্য উপাত্তের পাশাপাশি ডাটা বাণিজ্যিক ব্যবাহারে সুরক্ষা এবং ক্রসবর্ডার ডাটা বিনিময়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বার্থও যেনো ডাটা প্রোটেকশন আইন ২০২২ এ প্রাধান্য পায় তার দাবি জানান অংশীজনেরা। পাশাপাশি বেশকিছু পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
বিজিডি ইগভ সার্টের পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ জানান, ডাটা ইন্টার অপারেবলিটি এবং ক্রসবর্ডার ডাটা ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও আশিয়ান দেশগুলোর জোটের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আলোচনা সভায় অংশীজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া, বাক্কো সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ, বিসিএস সভাপতি সুবত্র সরকার, অ্যামটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এস এম ফরহাদ প্রমুখ।