সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে চীনের তানশাং ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরি ২০ সেট কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেন আমদানি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মেয়াদকাল ৩৫ বছর হলেও সাত বছরেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলো ১৪৯ জন যাত্রীবাহী ডেমু ট্রেনের ১৬টি। বছরের পর বছর ‘আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)’ রেখে নানা চেষ্টার পরও এগুলোকে সচল করা যাচ্ছিল না। তবে গত মাসের শেষ দিকে চীনের লুকিয়ে রাখা প্রযুক্তি হটিয়ে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিজেল ওয়ার্কশপে ৫টি ডেমু ট্রেন সচল করেছেন দেশের প্রকৌশলীরা। ফলে আবারো রেলে ফিরছে বিকল ট্রেনগুলো।
সূত্রমতে, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ডেমু ট্রেনগুলো যে বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত হতো সেই প্রযুক্তি কখনোই বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এর মডিউল বিকল হলে নতুন মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। এর জন্য ধর্ণা দিতে হত চীনা প্রকৌশলীদের কাছে। একটি ডেমুতে ৪০টি মডিউল রয়েছে। যার এক একটির দাম প্রায় ৭ লাখ টাকা। চীনা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি হস্তান্তর না করায় একটার পর একটা ট্রেন বিকল হতে থাকে। ফলে তাদের কাছ থেকে সারানোও ছিলো ব্যয়বহুল।
ফলে ২০২০ সালে মেরামতের অভাবে ট্রেনগুলো যখন বিকল হয়ে যায় তখন এসব সচল করতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী দেশি প্রকৌশলীদের সহযোগিতা নিয়ে ডেমু ট্রেন মেরামতে দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উদ্যোগী হন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। আসাদুজ্জামান ডেমু নিয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণাগার হিসেবে তিনি বেছে নেন সৈয়দপুর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের একটি কক্ষ। ৭২ দিনের প্রচেষ্টায় তিনি উদ্ভাবন করে ফেলেন বাস-ট্রাকের মতই ডেমু চালানোর প্রযুক্তি। ব্যয়বহুল মডিউল হটিয়ে দেন তিনি। সেক্ষেত্রে বসানো হয় মাত্র ২টি কন্ট্রোলার। আর চালু হয়ে যায় অচল ট্রেন।
.
একের পর এক ৫ সেট ডেমু সচল করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। দু’মুখে দুটি ইঞ্জিন মাঝখানে একটি কোচ। এরপর পর্যায়ক্রমে লোড বাড়িয়ে ট্রায়াল রান সম্পন্ন করা হয়েছে। এভাবে ৮টি ট্রায়াল রানের প্রতিটিতেই সাফল্য এসেছে। পার্বতীপুর থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত একটানা চালিয়ে নেওয়া হয় সদ্য সচল হওয়া ডেমু। কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রীভর্তি ডেমুর ট্রায়াল রান হয়। অচল ডেমু সচল করার পেছনের যার সবচেয়ে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, সেই রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী জানান, এ কাজটি ছিল তাদের জন্য অনেক দূরহ এবং চ্যালেঞ্জিং। তারা কখনো ভাবিনি ডেমু আবারও যাত্রী পরিবহনের উপযোগী করা যাবে। তবে অকেজো ডেমু মেরামত করে আমাদের প্রকৌশলীরা যুগান্তকারী সাফল্য দেখিয়েছেন। একটি ডেমু ট্রেন মেরামতে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা, যা আমদানি করা হলে কয়েক গুন বেশি টাকা ব্যয় হত। এ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করতে গিয়ে এরইমধ্যে দক্ষ জনবলও তৈরি হয়েছে। তাদের মাধ্যমে পরবর্তী মেরামত কাজও সহজ হয়।
প্রসঙ্গত, ডেমু ট্রেনগুলো ঢাকা- টঙ্গী, ঢাকা- জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী- লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পাবর্তীপুর-লালমনিরহাট, পাবর্তীপুর-পঞ্চগড় রুটে চলাচল করতো। ট্রেনগুলো মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে কম দূরত্বে ২০ কিলোমিটার এরমধ্যে চলাচলের জন্য কেনা হয়েছিল। কিন্তু অন্য রুটগুলোতে দূরত্ব চারগুণেরও বেশি ছিল, যে কারনে ট্রেনগুলো বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।