সাইবার ক্রাইম ও মানিলন্ডারিং মামলায় ফাঁস মুক্ত হতে গিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর ফ্রিলান্সিং করে অর্জিত টাকা এক রাতেই খুইয়েছেন চট্টগ্রামের এক ফ্রিল্যান্সার। আবু বকর সিদ্দিক নামের ওই ফ্রিল্যান্সারের এই টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিবির একটি টিমের বিরুদ্ধে। ডিবি টিমের সদস্যরা গভীর রাতে ওই ফ্রিল্যান্সারকে মনসুরাবাদের কার্যালয়ে তুলে নিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। ঘটনা সামনে আসার পর অভিযুক্ত সাত ডিবি সদস্যকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
গ্রেফতার করা হয়েছে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত কাওছার আহমেদ নামের এক যুবককে। এই যুবকের বাইন্যান্স হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। বাইন্যান্স হিসাব থাকার কারণে অভিযোগকরারী ফ্রিল্যান্সার আবু বকরের বিরুদ্ধেও একটি মামলা করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাই উচ্চ আদালতে গিয়ে আগাম জামিন নিয়ে এখন জীবন নাশের ভয়ে আছেন তিনি।
এদিকে ঘটনা তদন্তে গত শুক্রবার (১ মার্চ) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) একজন এডিসির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (উত্তর-দক্ষিণ) মোছা. সাদিরা খাতুন।
তিনি বলেছেন, বলেন, যেহেতু অভিযোগ এসেছে আমরা তদন্ত কমিটি করেছি এবং টিমে যারা ছিল তাদেরকে ক্লোজ করে রেখেছি। তদন্ত কমিটি দেখবে, ডিবির হাতে মোবাইল আসার পর টাকাগুলো গেল, নাকি আগে বা কোন পর্যায়ে গেল। টাকাটা যার মোবাইলে গিয়েছে সেও ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা করে, এখন আমাদের দেখার বিষয় এর সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু, যদি আমাদের টিমের সদস্যরা এর সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
সূত্রমতে, অনলাইন জুয়ার অভিযোগ তুলে আবু বকর সিদ্দিক নামে ওই ফ্রিল্যান্সারকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে দশটার দিকে ডিবি কার্যালয়ে ধরে নিয়ে যায় টিমটি। পরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তুলে নেয় দশ লাখ টাকা। এর বাইরেও কৌশলে তার বাইন্যান্স একাউন্ট থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার সমমানের ক্রিপ্টোকারেন্সি সরিয়ে নেন ওই ডিবি কর্মকর্তারা। সেইসঙ্গে তার মুঠোফোন ও পকেটে থাকা টাকা-পয়সাও কেড়ে নেন তারা।
এরপর আবু বকর সিদ্দিক ও ফয়জুল আমিন বেলালকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে মনসুরাবাদ গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডিবির পরিদর্শক রুহুল আমিন ও এসআই আলমগীরের নেতৃত্বে ফয়জুল আমিন বেলালকে নির্যাতন করা হয়। এ সময় আবু বকরকে মানিলন্ডারিং ও সাইবার ক্রাইমের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়।
বলা হয়, এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চালান দিলে ২০ বছরেও কারাগার থেকে বের হতে পারবে না। আবু বকরকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন পরিদর্শক রুহুল আমিন।
টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে নন-এফআইআর বা সিএমপির অধ্যাদেশ ১০৩/৯৪ মামলা করেন। প্রসিকিউশন নম্বর ৫৭। মামলায় বাদীসহ ৯ জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন নুরুল আরেফিন, এহছানুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন, এসআই মৃদুল কান্তি দে, এএসআই বাবুল মিয়া, এএসআই শাহপরান জান্নাত, কনেস্টবল মো. মমিনুল হক ও কনেস্টবল আবদুর রহমান।
পরদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাদের চট্টগ্রাম আদালতে চালান দেয়া হয়। আদালত তাদের ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। আবু বকর ও বেলাল জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে বের হন।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আদালত থেকে বের হেয় তিনি দেখতে পান যে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওই দিন রাতে তার হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে মোবাইলের লক খুলেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। ওই রাতে তাকে নগরের মনসুরাবাদে ডিবি হেফাজতে রাখা হয়। এ সময় তার মোবাইল থেকে ইউনাইটেড কমার্সিয়ল ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অন্য আরেকটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া তার বাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার (প্রায় তিন কোটি ৩৮ লাখ টাকা) স্থানান্তর করা হয়েছে।’
আবু বকর সিদ্দিক আরও বলেন, ‘ডিবির পরিদর্শক রুহুল আমিন, এসআই আলমগীরসহ সাত-আটজনের একটি টিম আমাকে বিভিন্ন মামলার ভয় দেখিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফ্রিল্যান্সিং করে আট বছর ধরে এসব ডলার জমিয়েছিলাম। অক্সিজেন এলাকায় আমার বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। গোয়েন্দা পুলিশ আমার সারা জীবনের আয় লুট করেছে। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বিট কয়েন কেনাবেচা করি না। তবে বিশ্বের বিভিন্ন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করি। তাদের কেউ কেউ আমাকে বিট কয়েনে পেমেন্ট করেন। সেই কয়েনগুলো আমার হিসাবে জমা ছিল। সেগুলো আমি নগদায়ন করতে না পারায় থেকে যায়। আমি ধারণা করেছিলাম যে ডিবি পুলিশ আমার যে ডলারগুলো চুরি করেছে সেগুলোকে অবৈধ আখ্যা দিতে এটা (মামলা) তারা করবে। এটার সুযোগ তারা নিয়েছে।’
তবে এ বিষয়ে নগর ডিবি পরিদর্শক রুহুল আমিনের বক্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) মোছা. সাদিরা খাতুন বলেন, ‘এখানে দুটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা আর অন্যটি ক্রিপ্টোকারেন্সি। যেটি বাংলাদেশে অবৈধ। ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। সেই কমিটি তদন্ত করে বের করবেন আসল ঘটনা কি? এ ছাড়া অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েন কেনাবেচার অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করা হচ্ছে। এ বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে।’