‘প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধা করলে দেশ পিছিয়ে যাবে’। আজ থেকে বিশ বছর আগে ২০০৪ সালের এপ্রিলে এমনটাই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন বদরুল হুদা খান। এই বক্তব্যটি প্রকাশিত হয় দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো’র উপ-সম্পাদকীয়তে। অবশ্য এরও আগে ১৯৯৫ সালে ‘ওয়েব বেইজড ইন্টস্ট্রাকশন’ নামে একটি বই লিখে আলোচনায় আসেন। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এর শিক্ষা প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর ২০১৪ সালে ন্যাটো‘র ই লার্নিং কনফারেন্স-এ তাকে আধুনিক ই-লার্নিং এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। দশ বছর বাদে বাংলাদেশে যখন স্মার্ট শিক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছে তখন যুক্তরাষ্টের দূরশিক্ষণ নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন ইউএসডিএলএ স্বীকৃত ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’র (হল অব ফেম-২০১৫) মুখোমুখি হন ডিজিবাংলাটেক.নিউজ এর নির্বাহী সম্পাদক ইমদাদুল হক।
প্রশ্ন: ই-লার্নিং ও স্মার্ট লার্নিং এর মধ্যে পার্থক্য কী?
বদরুল খান: ই-লার্নিং একটা মাধ্যম। তাই যখন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তখন তাকে আমরা ই-লার্নিং বলি। ইলার্নিং অনলাইন ও অফলাইনেও হয়। আর স্মার্ট লার্নিং হচ্ছে প্রযুক্তি বান্ধব টেকসই, প্রেরণাময় এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো সেই শিক্ষণ প্রক্রিয়া যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থায় শিক্ষার্থীকে সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে। এই শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যা শেখা হয় তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক ভাবে প্রতিফলিত হয়। এই শিক্ষণ কার্যক্রমটি চলবে অনলাইন-অফলাইনের সংমিশ্রণে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোন মাধ্যমে শিখছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ডিজিটালি আমরা অনলাইন ও অফলাইন দুই ভাবেই পড়তে পারি। স্মার্ট লার্নিংয়ে এরসঙ্গে যুক্ত হবে সরাসরি ক্লাসরুমে পাঠদানও। স্মার্ট লার্নিং তখনই হবে যখন শিক্ষার্থীরা যে কোনো সময় নিজে নিজে শেখার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষকেরও সহায়তা নিবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোনটা নিজেরা নিজেরা পারবে আর কোনটায় সহায়তা নেতে তা আগেই নির্ধারণ করা হবে। তাই শিক্ষা নির্দেশিকায় কোন বিষয়বস্তু ডিজিটালি আর কোনটা শিক্ষকের সরাসরি হাতে কলমে শিক্ষা দিতে হবে তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে আগে ভাগেই।
প্রশ্ন: স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প ঘোষণা করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সরকারকে কী পরামর্শ দেবেন?
বদরুল খান: স্মার্ট লিভিং নিশ্চিত করতে হবে। নতুন দিগন্তে প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি স্মার্ট লার্নিংয়ে কী কী দরকার তা যথাযথ ভাবে নির্ধারণ করে সরবরাহ করবে।
প্রশ্ন: স্মার্ট শিক্ষা বাস্তবায়নে সামনে দিনে দেশে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
বদরুল খান: এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তুত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইনের ওপর শিক্ষকদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিতে হবে। সবার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সুলভ করা এবং শিক্ষার্থীর জন্য ব্যক্তিগত লার্নিং ডিভাইস নিশ্চিত করাও চ্যালেঞ্জের। সর্বোপরি শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সবার জন্য ইন্টারঅ্যাক্টিভ করে তোলা।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ফলে নামী-দামী স্কুলে পড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত রীতিমতো অভিভাবকেরা যুদ্ধে নামেন। স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থা কী সেই যুদ্ধকে থামাতে পারবে? তাহলে কিভাবে?
বদরুল খান: সারা বিশ্বেই এই প্রথা চলছে। এটা অযৌক্তিক। এ থেকে বের হতে আমাদের শিক্ষার্থীরা ঠিক মতো শিখছে কি না কিংবা চাকরিদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কি ঠিক ঠাক শেখাতে পারছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য চাকরি দাতাদের মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে। আশা করি স্মার্ট এড্যুকেশন এই ট্যাবু ভেঙ্গে ফেলবে।
প্রশ্ন: বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টেকসই শিক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠ্যক্রম কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? প্রযুক্তি কি এক্ষেত্রে টেকসই কোনো সমাধান দিতে পারবে?
বদরুল খান: অবশ্যই পারবে। সে জন্য দরকার, বিষয়বস্তুগুলোকে কিভাবে এবং এঙ্গেজিং ওয়েতে শেখানো যায়। পাঠ্যক্রম অবশ্যই সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নির্ভর কন্টেন্ট দিয়ে সাজাতে হবে। এটাকেই আমি কর্মমুখী, দক্ষতামূলক ও জীবনব্যাপী শিক্ষা বলি।
প্রশ্ন: সরকার ব্লেন্ডেড লার্নিং নিয়ে কাজ করছে। আপনি সেই জাতীয় কমিটির সদস্য। প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। কাজ কতদূর এগুলো? কেমন ফল দিয়েছে?
বদরুল খান: আমার ভালো লাগছে যে, আমি দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইন তুলে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের কীভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষা দেয়া যায় সে বিষয়ে কথা বলেছি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তাদের মতামতও নিয়েছি। আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক করা দরকার। শিক্ষার্থীরা যা শিখছে তার প্রতিফলন কিভাবে হবে তাতে গুরুত্ব দিতে হবে মানবিক ও নীতিতে। দেশপ্রেমকে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন: উপমন্ত্রী থেকে এবার দ্বাদশ সংসেদ পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন আপনার জেলার সন্তান মহিবুল হাসান নওফেল। স্মার্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে তার কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
বদরুল খান: আমাদের দেশ অনেক এগিয়েছে। সচল শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হলে শিক্ষাকেও সেভাবে এগিয়ে যেতে হবে। কারিকুলামে জীবনমুখী ও দক্ষতামূলক শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। তার বাবা চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকে তিনি চট্টগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক ই-লার্নিং কনফারেন্স আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর প্রচার-প্রসারে তিনি আমাকে দিয়ে তার প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করোপোরেশন থেকে পরিচলিত স্কুলগুলোতে সেমিনার করিয়েছেন। আমি আশা করি শিক্ষা অনুরাগী পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে তিনি আমাদের দেশ ও দশের কল্যাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের জন্য দক্ষতামূলক, কর্মমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা নিশ্চিত করবেন। শিক্ষার সঙ্গে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযুক্ত করবে। শিক্ষা যেনো শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধিৎসু করে সে বিষয়ে জোর দেবে। কেননা, স্মার্ট শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে ধারণ করে কর্মমুখী, দক্ষতামূলক জীবনব্যাপী শিক্ষা নিশ্চিত করা। আর এর মাধ্যমেই পূর্ণতা পাবে স্মার্ট বাংলাদেশ।