ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে কত টাকা পাচার করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তা নিরুপণ করতে এবং পাচার হয়ে থাকলে কে বা কারা জড়িত তা চিহ্নিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি কার বা কাদের অবহেলায় ই-কমার্স গ্রাহকরা গুরুতর লোকসান ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২৩ মে) বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব, মোহাম্মদ শিশির মনির ও আনোয়ারুল ইসলাম বাধন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টের একই বেঞ্চ আদেশের জন্য ২২ মে ধার্য করেন। কিন্তু আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি এফিডেভিট আকারে জমা দিতে না পারায় সেদিন তারা নট টুডে নেন। এরপর শুনানির জন্য আজকের দিনের জন্যে আদেশ দেন আদালত।
গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর অনলাইন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতি অনুযায়ী একটি স্বাধীন ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাধন।
একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দুই ই-কমার্স গ্রাহকের পক্ষে আরেকটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব।
রিটে ইভ্যালি, আলিশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, দারাজ, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ ও দালাল প্লাসের মতো ই-কমার্স মার্কেট প্লেসের লাখ লাখ গ্রাহকের লোকসান ও গুরুতর আর্থিক ক্ষতি নির্ণয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এছাড়া ই-কমার্স গ্রাহকদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী ও অন্য অংশীজনদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে ৩৩ ভুক্তভোগী গ্রাহক রিট করেন।
আবেদনকারীরা বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে ১৬ কোটি টাকা পরিশোধের পরও পণ্য বা অর্থ ফেরত কিছুই পাননি। এ কারণে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন।
রুলে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ই-কমার্সের গ্রাহকরা গুরুতর লোকসান ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, সেসব ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে চিহ্নিত করতে বিবাদিদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ই-কমার্স থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বা আদৌ পাচার হয়েছে কিনা, হয়ে থাকলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ নিরূপণ ও পাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন।
একইসঙ্গে ই-কমার্স ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে বিবাদিদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের কার্যাবলী তদারকি করতে একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ ওঠা ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির ব্যাপারে আংশিক তদন্ত শেষ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউয়ের পক্ষে তাদের আইনজীবী হাইকোর্টকে জানিয়েছেন, ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকমসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ কোথায় গেছে, পাচার হয়েছে কি না সে ব্যাপারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
এর আগে হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ডটকমের ১৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৬৭টি হিসাবের আনুষঙ্গিক দলিলাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। হিসাবগুলোতে লেনদেনের বিবরণী থেকে জানা গেছে, ইভ্যালি ডটকম লিমিটেড ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে প্রাপ্ত ৩৬টি হিসাবে (সঞ্চয়ী চলতি) মোট ৩৮৯৮ দশমিক ৮২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
এর মধ্যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমা প্রায় ১৯৫৬ দশমিক ১৯ কোটি টাকা ও উত্তোলন হয়েছে প্রায় ১৯৪ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সেলিম রেজা, ফরিদ হোসোইন, তারিক রহমান রাকিবুর ৫০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেছেন। ৩৬টি অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।