নারীরা জ্ঞানে আছে বিজ্ঞানে নেই। এই দুঃখটা এখন ঘুচতে যাচ্ছে। ইউনেসকোর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশ নারী (স্নাতকে ৪৪ ও স্নাতকোত্তরে ৫৫), আর পিএইচডি পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় নারী পুরুষের প্রায় সমকক্ষ হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। সম্প্রতি ‘নেচার’ সাময়িকীর এক গবেষণায় দেখা যায়, ৮৩ হাজার গবেষণাপত্রের মাত্র ১৭ শতাংশের প্রধান গবেষক ছিলেন নারীরা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৭ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী শিক্ষার্থীর হার মাত্র ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অন্যান্য প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ হার আশাব্যঞ্জক নয়।
তবে হিসেবটা পুরোনো। বাস্তবতা হচ্ছে নাচ, গান, আবৃত্তি বা ছবি আাঁকার মতো প্রযুক্তিতেও বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে তারা ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছেন প্রযুক্তি অঙ্গনে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে গত ৫ বছরে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ফ্রিল্যান্সার ডেভলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. তানজীবা রহমান। তিনি জানান, গত ৫ বছর আগে দেশে নারী ফ্রিল্যান্সারের হার ছিলো ৩ শতাংশ। কিন্তু এখন উন্মুক্ত মার্কেট প্লেস সংখ্যার দিক দিয়ে নারীদের হার ১১ শতাংশ। আয়ে সফল নারীদের হার ৪ শতাংশ। এই হারটা আরো বাড়াতে হলে মেয়েদের জেদী ও চ্যালেঞ্জ ফেস করতে না পারাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন তিনি।
নারীদের প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার একই ধরনের তথ্য মিললো বিডব্লিউআইটি’র সভাপতি রেজওয়ানা খান-এর কাছ থেকে। তিনি জানালেন, বাংলাদেশে এখন কোর টেক (সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার) খাতে সংযুক্ত কর্মীর মধ্যে ১৫ শতাংশই নারী। আর ই-কমার্স ও বিপিও হিসাব করলে এটা ২৫ শতাংশ।
এদিকে উই সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা জানান, বাংলাদেশ এফ কামার্স-এ নারী-পুরুষ অনুপাত ৪০:৬১। গত চার বছরে এই হার দ্বিগুণ বেড়েছে। নারীরা এখন কৃষি-মৎস, চামড়া ও পাটের মতো উপকরণ নিয়ে কাজ করছে। তারা এখন পণ্যে ফিউশন করছে। উদ্ভাবনের দিকে যাচ্ছে। দেশের বাইরে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে, তা এখনও মোট সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। বিজ্ঞান গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে। আইসিডিডিআরবির গবেষকদের তালিকা পর্যালোচনা করে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এতে দেখা যায়, মোট গবেষকের এক তৃতীয়াংশ নারী।
এ নিয়ে প্রযুক্তি খাতের নারী অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি গবেষণাতে এখন এগিয়ে আসাতে গুরুত্বারোপ করেছেন আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। তিনি উপমহাদেশের প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি ২০১২ সালে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে ক্রিস্টোফ এবং রুডলফ মেরিইয়ু ফাউন্ডেশন পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, গবেষণায় অনেক কষ্ট করতে হয়, অনেক চেষ্টা করতে হয়। নারীরা চাইলেই সেটা করতে পারেন। গবেষণা বা এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ নারীর ব্যক্তিত্ব পুরোটাই বদলে দিতে পারে।
একইভাবে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও নারীদের স্টেম (Science, Technology, Engineering & Mathematics) ক্ষেত্রে শিক্ষা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সেক্রেটারি প্রফেসর হাসিনা খান মনে করেন, নারীরা স্টেম বিষয়গুলোয় পড়াশোনা করলেও পরে পেশা হিসেবে নিতে উৎসাহী হন না। কারণ পেশাগত নিরাপত্তা ছাড়াও সুযোগ কম এবং প্রচুর সময় দিতে হয়। ফলে সংসারী একজন নারী বেশির ভাগ সময় এ চ্যালেঞ্জটা নিতে পারেন না। তবে ট্যাবু ভাঙছে, পদার্থবিজ্ঞানী মারি কুরি, ফেরদৌসী কাদরী, গণিতবিদ ড. ক্যারেন উলেনবেকের মতো রোল মডেল তাদের সামনে রয়েছে। দেশি ফিড ও সিড কোম্পানিগুলোয় গবেষণার একটা সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রগুলোয় গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করলে বিজ্ঞান শিক্ষায় যারা এগিয়ে এসেছে, তাদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে।
অপরদিকে রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম বাসস এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে এখনো মনো-সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় অংশগ্রহণ কম দেখা যায়। এমনকি উচ্চশিক্ষিত, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে যুক্ত অভিভাবকগণও কন্যা সন্তানদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত করতে চাইলেও, বিজ্ঞানে যুক্ত করতে চান এমন অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস এন্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেছেন, আর্থ-সামাজিক কারণে বিজ্ঞান শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম দেখা যায়। বেশিরভাগ অভিভাবক মেয়েদের পড়ালেখার পেছনে অপেক্ষাকৃত কম খরচ করতে চান। যেহেতু বিজ্ঞান বিষয়ক পড়ালেখায় খরচ বেশি, তাই মেয়েদের বিজ্ঞান পড়ানোর আগ্রহ অভিভাবকদের মধ্যে কম।
বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২২ সালে ‘উইমেন আইসিটি পার্সোনালিটি অব দ্যা ইয়ার ২০২২’ অর্জন কারী এই শিক্ষাবিদ জানালেন, এই শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং তারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন।
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের সমীক্ষায় বিশ্বসেরা ১০ জন অণুজীব বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন বাংলাদেশের তরুণী সেঁজুতি সাহা। বাংলাদেশে প্রাপ্ত নতুন করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স শনাক্ত কারী দলের এই নেতা বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে পরিবর্তন হলেও প্রেক্ষাপট এখনও ততটা বদলায়নি। সমাজে অনেক পরিবর্তন আসছে। মেয়েরা বাইরে যাচ্ছে। বাইরে কাজ করছে। কিন্তু, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের দুটো জায়গাই সামলাতে হয়।’
সেঁজুতি বলেন, ‘বিজ্ঞান ও গবেষণায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে কাজটা ভাগ করে নিতে হবে। যতদিন না নারীরা পুরুষের সাথে সমান সমান ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে ততদিন পর্যন্ত নারীদের বেশি সাপোর্ট দিতেই হবে। আমরা তো এখন একটা লেভেল ফিল্ড এ আছি। ছেলেরা তো অনেক দিন ধরে কাজ করছে। কাজেই নারী-পুরুষের মাঝখানে ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে হলে নারীদের প্রতি অনেক বেশি এটেনশন দিতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আয়োজিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যাকাথন প্রতিযোগিতা নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের ‘মোস্ট ইন্সপিরেশন’ ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের দল ‘টিম ডায়মন্ডস’। এই দলের দলনেতা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী টিসা খন্দকার। তার দলের অন্য চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে এবং তিনজন ছেলে।
টিম ডায়মন্ডস দলটি মহাকাশের বিভিন্ন রহস্য নিয়ে তৈরি ‘ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই’ ইন্টারঅ্যাকটিভ গেম তৈরি করে প্রতিযোগিতায় গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পেয়েছে। শিশুদের জন্য তৈরি এই গেমটি খেলার ছলে শিশুদের মহাকাশের বিভিন্ন রহস্য জানার সুযোগ করে দেয়।
তিন রোবটবিদ কন্যার মা ড. সৈয়দা মোমেনা আফসানা বাসসকে বলেন, বাংলাদেশে সার্বিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে বিজ্ঞান শিক্ষায়ও গত দশ বছরে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, যা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। তবে, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার এখনও অনেক বেশি।
ড. মোমেনা বলেন, নাচ, গান, আবৃত্তি বা ছবি আাঁকার মতো প্রযুক্তিও যে বাচ্চাদের শখ হতে পারে সেটা মানতে বোধ করি আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে। তবে, এখন মানুষের চিন্তা বদলাচ্ছে। বাচ্চারা যদি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড না করে বিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোযোগী হয় তাহলে তাদের সেই সুযোগই দেয়া উচিত।
অবশ্য এরইমধ্যে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের উদ্ভাবন নারীদের অনন্য আর্থিক চাহিদা ও চাহিদা পূরণের পথ খুলে দিয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য সরকারি ডিজিটাল ফাইনান্স পরিষেবা অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট- এটুআই-এর ‘সাথী’এবং মাইক্রোক্রেডিট সফটওয়্যার ‘স্বস্তি’ মোবাইল ব্যাংকিং এবং মাইক্রোলোনের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে। নারীরা অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন, মুঠোফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাতা ও সহায়তা পাচ্ছেন, তথ্য পাচ্ছেন, এমনকি আইনগত ও স্বাস্থ্যসেবাও অনলাইনের মাধ্যমে পাচ্ছেন।
২০২১ সালের ১ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘জেনারেশন ইকুইটি ফোরাম’-এ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘টেক স্টার্টআপ ও ই-কমার্সসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০২৬ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু সরকারি হিসাবমতে দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ২৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা করলেও কর্মক্ষেত্রে মাত্র ১২ শতাংশ নারী কাজ করছেন, যাঁদের অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কাজ করেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অবস্থান শতকরা ১ শতাংশের চেয়েও কম। অপরদিকে ২০২২ এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে দেশের নারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এছাড়া দেশের ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারে সেলুলার মোবাইল ফোন রয়েছে। পাশাপাশি স্মার্টফোন রয়েছে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারে। ২০১৩ সালে যেখানে নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করত ৪. ৮ শতাংশ পরিবার, আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.১ শতাংশে। এই হিসেব বলছে, প্রযুক্তি নারীদের জন্য এসেছে অপার সম্ভাবনার হাতিয়ার হিসেবে। এখন ভাঙতে হবে সামাজিক ট্যাবু।
ইমদাদুল হক : নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিবাংলাটেক