সমাপ্তি হলো আরও একটি বছরের। ভাল-মন্দের বছর। কিছু আনন্দ, কিছু বিষাদের। থাকে কিছু আলোচনা, কিছু সমালোচনা। ২০২২ সালে ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আলোচনা কিংবা সমালোচনা যেটাই বলা হোক সেটাতে ছিলেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। এছাড়া বিশ্বমন্দাসহ নানা নানা অজুহাতে গণছাঁটাই চালিয়েছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রাম মালিকানা সংস্থা মেটাসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। চলুন ফিরে দেখা যাক কেমন গেলো ২০২২ সাল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব প্রযুক্তি খাতেও
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত হ্যাকার গ্রুপ অ্যানোনিমাস রাশিয়াতে সাইবার আক্রমণের ঘোষণা দেয়। রাশিয়ার সরকারি ও মিডিয়া ওয়েবসাইট এবং ডেটাবেজে আক্রমণ চালায় তারা। রাশিয়ান সাইটগুলোকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্ঠাও দেখা যায়। বড় প্রযুক্তি কোম্পানি যেমন টুইটার, মেটা, ইউটিউব এবং টিকটক রাশিয়ার সরকারি গণমাধ্যম এবং সরকারি অ্যাকাউন্ট ও পেজ ব্লক করে দেয়। এছাড়া রাশিয়া দেশটিতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটার বন্ধ করে দেয়, যদিও ইউটিউব চালু রয়েছে। এর কারণ হলো, রাশিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউটিউব ব্যবহার করেন।
ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের বড় দরপতন
২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দায় ডিজিটাল মুদ্রা হিসাবে ব্যাপক পরিচিত বিটকয়েনের বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। ২০২১ সালে যে বিটকয়েনের মূল্য প্রায় সাড়ে ৬৫ হাজার ডলারে উঠেছিলো, সেটি ২০২২ সালে একাধিকবার ১৯ হাজার ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এছাড়া বছরের শেষের দিকে এফটিএক্সের দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিও বেশ আলোচনায় রয়েছে।
টুইটার ও মাস্কের কাণ্ড
২০২২ সালের শুরুতেই কানাঘুষো ছিলো টুইটার কিনতে চলেছেন বিশ্বসেরা ধনী ইলন মাস্ক। প্রথমবার এপ্রিল মাসে জানা যায়, টুইটার কিনে ফেলেছেন। যদিও এরপর মালিকানা সংক্রান্ত নানা টালবাহানা চলতে থাকে। মামলা গড়ায় আদালতে। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরে টুইটারের মালিকানা পান। মোট ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সম্পূর্ণ করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় মাস্ককে। জানা যায়, এই বিপুল অঙ্কের লেনদেন করার জন্য তাঁকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হয়। এর জেরে টুইটার থেকে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করতে পারেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন অনেকে। বাস্তবেও তাই হয়। সংস্থার মালিকানা পেয়েই ছেঁটে ফেলেন টুইটারের ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও পরাগ আগরওয়ালকে।
মাস্ক টুইটার কেনার পর শুরু হয় আরেকপ্রস্থ বিতর্ক। জানা যায়, শেষ হচ্ছে টুইটারে বিনামূল্যে ব্লু টিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের দিন! এবার থেকে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের জন্য খসবে পকেটের কড়ি। এদিকে ক্ষমতা পেয়েই মাস্ক যেমন ছাঁটাই করেন সংস্থার বহু কর্তাকে, তেমনই কোম্পানির নয়া নীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে টুইটারের বেশ কয়েকজন কর্তা নিজে থেকেই ইস্তফা দেন। মাস্কের দাবি, টুইটারকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে বিশ্বব্যাপী সংস্থার বহু কর্মীকে ছাঁটাই জরুরি ছিলো। ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হলেও এই সিদ্ধান্ত তাঁদের নিতে হচ্ছে, জানান মাস্ক। টুইটারের বিশ্বজুড়ে কর্মী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। যা অর্ধেক করে ফেলা হয় এক ধাক্কায়। পরে বিপুল সংখ্যক চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়। এবং মাস্কের সর্বশেষ বিস্ফোরক খবর হলো টুইটারের সিইও পদ ছাড়তে পারেন তিনি।
গণছাঁটাই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপে
২০২২ সালে টুইটারের মতো ঘন ঘন খবরে আসেনি ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ। এমনিতে যুগের প্রয়োজনে তিন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম আপডেট হয়েছে। উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি, অ্যাপে পরিবর্তন এসেছে। এই অবধি। তবে বছর শেষে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রামের মালিকানাধীন সংস্থা মেটা খবরে আসে গণছাঁটাইয়ের কারণে। নভেম্বরে একসঙ্গে ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে তারা। উন্নতির জন্যই ঐতিহাসিক কর্মী ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপ, জানানো হয় কোম্পানিটির পক্ষ থেকে। বিশ্বজুড়ে গণছাঁটাইয়ের পর দুঃখ প্রকাশ করেন মার্ক জুকারবার্গ। ২৮ বছরের মেটার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাঁটাইয়ের সাক্ষী হয় সিলিকন ভ্যালির এই সংস্থা।
হোয়াটসঅ্যাপে বিভ্রাট
২০২১ সালের পর ২০২২ সালেও আচমকা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২৭ অক্টোবরে প্রায় দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিলো জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপটি। এমন বিভ্রাটের কারণ কী, হোয়াটসঅ্যাপের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে কিছু জানানো না হলেও এই নিয়ে মুখ খোলে মেটার এক মুখপাত্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মুখপাত্রের দাবি, বড় ধরনের প্রযুক্তিগত ত্রুটি হয়েছিলো।
গুগলকে পিছনে ফেলে শীর্ষে টিকটক
গুগলকে পেছনে ফেলে এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন সাইট টিকটক। চীনভিত্তিক শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মটি সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগলের চেয়েও বেশি ‘হিট’ বলে জানিয়েছে আইটি নিরাপত্তা কোম্পানি ক্লাউডফ্লেয়ার। ২০২১ সালেও টিকটক ছিলো বিশ্বের সেরা অ্যাপ। এরপর শীর্ষ দশে টিকটকের পর আছে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, জুম, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ক্যাপকাট, স্পোটিফাই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বিশ্বকাপ’ রেকর্ড
গত ১৮ ডিসেম্বর ছিলো কাতার ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২২-এর ফাইনাল। আর্জেন্টিনা ও শেষ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ান ফ্রান্স মুখোমুখি হয় কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া উন্মাদনায় শেষ হাসি হেসেছিলেন মেসির আর্জেন্টিনা ও তার সমর্থকেরা। আর এই ম্যাচকে ঘিরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একের পর এক রেকর্ড গড়তে থাকে।
বিশ্বকাপ ফাইনালের কারণেই গত ২৫ বছরের ট্রাফিকের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে গুগলের। মেসির ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করা একটি ছবি এই মুহূর্তে ইনস্টাগ্রামের সবচেয়ে লাইক শেয়ার হওয়া ছবি। সেই ছবিতে লাইক পড়েছে সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি। এই ছবিটি কোনো ক্রীড়াবিদের পোস্ট করা ছবি, যাতে সর্বাধিক লাইক পড়েছে। এর আগে এই রেকর্ড ছিলো পর্তুগিজ মহাতারকা রোনালদোর দখলে।
বিশ্বকাপ ফাইনাল চলাকালীন হোয়াটসঅ্যাপে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ মিলিয়ন বার্তা আদান-প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, টুইটারে বিশ্বকাপ ফাইনাল চলাকালীন প্রতি সেকেন্ডে ২৪ হাজারেরও বেশি টুইট করা হয়েছে।