কেবল উপহার দেয়া বা সেলিব্রেশন ফিশিং লিংক নয় সরকারবিরোধী প্রচারের নানা ভিডিও লিংকে বিপজ্জনক ম্যালওয়্যার ও স্পাইওয়্যার ছড়াচ্ছে সাইবার অপরাধীরা। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে তারকা খ্যাতি বা সমাজের নামিদামি মানুষকেন্দ্রিক প্রচারমূলক ভিডিও। এসব ভিডিওর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করে অবাধে ছড়ানো হচ্ছে ‘হেট স্পিস’ ও ‘সাইবার বুলিং’। আবার ভাড়াটে সাইবার কর্মীদের মাধ্যমে গুগল অ্যাডসেও ঝুঁকি পাসওয়ার্ড চুরিতে সক্ষম ম্যালওয়্যার ছড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নানা বিষয়কে পুঁজি করে দেশের সাইবার জগতে ‘বড়শি’ ফেলছে আন্তর্জাতিক সাইবার দুবৃত্তরা।
অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে একজন ব্যবহাকারী অ্যাড দিয়ে মূল্য পরিশোধের পর প্রায় এক মাস তার অ্যাডস ‘পেন্ডিং’ দেখাচ্ছে গুগল। এরপর অ্যাডদাতা অ্যাড প্রত্যাহার করে অ্যাকাউন্ট বাতিল করলে নিয়ম অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে সেই অ্যাকাউন্টে ফেরত যাওয়ার কথা থাকলেও দুই মাস পরও গ্রাহক সেই অর্থ ফেরত পাননি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য গুগলে-ফেসবুকের নির্দিষ্ট কোনো যোগাযোগ ক্ষেত্র (কমিউনিকেশন পয়েন্ট) না থাকায় এসব প্লাটফর্মে ক্ষতির শিকার হয়েও প্রতিকার পেতে নাকাল হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এই প্রযুক্তি জায়ান্টদের বাংলাদেশে অফিস স্থাপনে বাধ্য করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। তিনি বলেন, সরকার যেহেতু এ ধরনের এড থেকে রাজস্ব পাচ্ছে, তাই এখানে অফিস না থাকলে অফিস স্থাপনের বিষয়ে চাপ দিতে পারে সংশ্লিষ্টদের। এতে সেবা নিশ্চিত হলে ব্যাবসা বাড়বে, রাজস্ব বাড়বে সরকারের।
বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা কেন গুগল-ফেসবুকের কাছে পাত্তা পায় না জানতে চাইলে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার (এপনিক) এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির ডিজিবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে অনেক ধরনের অপপ্রচার হয়। কিন্তু সেগুলো ফেসবুক-গুগল ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো অতো সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা করে না। অভিযোগ করলেও তারা সরকার এবং বেসরকারি সব ধরনের অভিযোগই টার্ন ডাউন করে। এর কারণ তাদের যে রোবট তারা বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝে না। তাই বাংলায় গালি-গালাজ করলে ওরা তা বোঝে না। এটা একটা টেকনিক্যাল সমস্যা। দ্বিতীয়ত ওদের যে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড আছে তা আমাদের সব কিছুর সঙ্গে মেলে না। তাই আমরা আটকে যাই। তাই এ বিষয়ে যদি ওদের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় কেউ থাকতো তাহলে সুফল মিলতো। আর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- ওদের সঙ্গে আমাদের ট্রাস্টের একটা বড় গ্যাপ আছে। কেননা এখান থেকে এমন অনেক রিক্যুয়েস্ট যায়, যেগুলো আসলে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা পাওয়ারফুল তাদের বিষয়ে অভিযোগ যায় কিন্তু যারা সাধারণ তাদের ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে কোনো রিক্যুয়েস্ট যায় না। কাজেই অন্যান্য দেশের চেয়ে তারা আমাদের রিক্যুয়েস্ট কম শোনে। এছাড়াও কিছু লোকের বিরুদ্ধে সামান্য কথাও বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না। এই জায়গা থেকে আমাদের নিয়ে ওদের ট্রাস্টহিনতা রয়েছে।
গুগলের স্মার্টফোন প্ল্যাটফর্ম অ্যান্ড্রয়েডের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণকারী ‘অ্যান্ড্রয়েড পুলিশে’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক এই ঝুঁকির বিষয়ে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের নামও। গুগল সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারবিরোধী প্রচারের নানা ভিডিও এবং তারকা খ্যাতি বা সমাজের নামিদামি মানুষকেন্দ্রিক প্রচারমূলক ভিডিওর লিংকেই বিপজ্জনক ম্যালওয়্যার যুক্ত হচ্ছে বেশি। আপত্তিকর ভিডিওগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট করে কিংবা বিদেশ থেকে বুলিং বা ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তিদের রুখতে না পারায় বাংলাদেশ কী তাহলে অসহায় জানতে চাইলে এর সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে এ বিষয়ে নিজেদের সক্ষমতা ও যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।
ডিজিবাংলা’র সঙ্গে আলাপ কালে তিনি সাইবার কুটনীতি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আমাদের এখন উচিত আইটিইউ (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) এর অধীনে সার্কভূক্ত দেশগুলোসহ ইউরোপের দেশগুলোতে একটি করে ফোরাম করা যেতে পারে। এই ফোরামগুলো যদি একক প্লাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইনেই সাইবার দুবৃত্তদের তালিকা সরবরাহ করে তাহলে বৈশ্বিক আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সহজ হবে।
বিষয়টি নিয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ডিজিবাংলাকে বলেন, সাইবার স্পেসের সুরক্ষায় আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলোনায় যে কোনো দিক থেকে এগিয়ে আছে। আইটিইউ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিলে আমরা অবশ্যই তাতে অংশ নেবো। কেননা ইউরোপ আর বাংলাদেশের (এশিয়া) পরিস্থিতি ও বাস্তবতা এক নয়।
মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে সাইবার স্পেস দখল করে আছে সে দিকটাও নজরে দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের পর সার্বজনীন প্রযুক্তি আন্দোলনের দেড় দশকের এই ডিজিটাল যোদ্ধা।
অ্যান্ড্রয়েড পুলিশের পর্যবেক্ষণ বলছে,ব্যবহারকারীর বিভিন্ন সেবার পাসওয়ার্ড এবং ডিভাইসে থাকা ছবি, ভিডিও, ডকুমেন্ট ফাইল চুরি, গুগল অ্যাডসের বিজ্ঞাপনের অর্থ হাতিয়ে নেয়া এবং ফেক নিউজসমৃদ্ধ ভিডিওগুলোতে রিপোর্ট করা হলেও সেগুলো গুগলের সাপোর্ট টিমের কাছে যেতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কনটেন্টে বিপজ্জনক লিংক যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে ব্যবহারকারীরা আপত্তিকর ভিডিওগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট করলেও তা গুগলের সাপোর্ট টিমের কাছে যাচ্ছে না।
বিপুল অংকের ব্যবসা থাকার পরও গুগল-ফেসবুক কেন বাংলাদেশের বিষয়ে উন্নাসিক জানতে চাইলে তানভীর জোহা ডিজিবাংলা-কে বলেন, বাংলাদেশে জিডিপিআর না থাকা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রাযুক্তিক কমপ্লায়েন্স না থাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই এ নিয়ে আলোচনা হলেও সুফল মিলছে না। তাদের সাপোর্ট টিম বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয় না। এমনকি আমরা যদি প্রতিবেশী ভারতের কোনো সাইবার দুবৃত্ত সম্পর্কে জানতে চাই তাহলে আইনি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে হয়। অর্থাৎ দেশের বাইরের অপরাধীদের আমরা আমাদের আইনে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি না। এতে দুর্বত্তরা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে এই সমস্যাগুলো সমাধানে এরই মধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে বলেও আভাস দেন তিনি।