দেশের ইতিহাসে প্রথবারের মতো দীর্ঘ বক্তব্যের মাধ্যমে বাজেট প্রস্তাব না করে, অডিও ভিজ্যুল উপস্থাপনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার (১১ জুন) বিকেলে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের অধস্তন আদালত সমূহকে আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিটি আদালতকে ই-কোর্ট রুমে পরিণত করা হবে। এছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে মুস্তফা কামাল বলেছেন, অচিরেই সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি করে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হবে।
তবে মোবাইল ফোনে সিম-রিমের মাধ্যমে দেয়া সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন তিনি। এর ফলে বাড়তি শুল্কে মোবাইল গ্রাহককে কথা বলায় ও ডেটায় বেশি টাকা খরচ করতে হবে।
এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ বলেছেন, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়াবে। এটা হতাশাজনক। আর সরকার প্রতিনিয়ত এই খাতের ওপর করের বোঝা চাপাচ্ছে। এ কারণেই জিডিপিতে অবদান ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দুই অংকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার যে কথা আমরা বলেছিলাম, সেটি অর্জিত নাও হতে পারে। দেশকে ডিজিটাল ইকোনোমির দিকে নিয়ে যাওয়ার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে এই খাতটি আরো ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হবে।
আগামীতে টেলিকম সেবা দেয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকা মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক এর চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, আমাদের গ্রাহকরা ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত করের বোঝা মাথায় নিয়ে সেবা নিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যাত্রায় তাদের অংশগ্রহণ আরো কমবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তথ্য-প্রযুক্তি খাতের লোডেড পিসিবি (প্রিন্টার সার্কিট বোর্ড), আনলোডেড পিসিবি এবং রাউটারের ওপর পাঁচ শতাংশ মূসক আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে। একইসঙ্গে উৎপাদনশীল কাজে ব্যববহৃত ইন্টারনেট ব্যবহার খরচ বাড়া ছাড়া কমার কোনো অবকাশ থাকছে না।
ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি মহাসচিব ইমদাদুল হক বললেন, ইন্টারনেট বিলাসী পণ্য নয়। এটি মৌলিক একটি চাহিদা। বাজেটে আমরা সরকারের কাছে ৩টি দাবি করেছিলাম। ইন্টারনেট সেবাকে আইটিইএস সেবার অন্তর্ভূক্তি করা, আইটিসি, আইআইজি, এনটিটিএন এবং আইএসপি- প্রতিটি স্তরে ভ্যাট সমান ৫ শতাংশ করার পাশাপাশি আমরা যে ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে সেবা দেই, সেই ওএনইউ বা ওএলটি’র ক্ষেত্রেও ভ্যাট ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু এর একটি দাবিও পূরণ হয়নি। এই পর্যায়ে আমাদের কারোরই ইন্টারনেট মূল্য বাড়ানো ছাড়া কোনো গতি নেই।
এদিকে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলকে জনপ্রিয় করতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে ২০২০-২১ সালের বাজেট প্রস্তাবনায়। যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করবে তাদেরকে ২ হাজার টাকা কর ফেরত দেয়া হবে। যা আয়কর বিভাগের ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। অপরদিকে রেফ্রিজারেটর ও এসির কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। একইসেঙ্গ দ্রুতবর্ধনশীল মোবাইল খাতের সম্প্রসারণে স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল সেট উৎপাদনের উপর মূসক অব্যাহতি এবং সংযোজন খাতে ৫ শতাংশ হারে মূসক অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো সুখবর মেলেনি।
ফলে সব মিলিয়ে বাজেট নিয়ে খুব একটা স্বস্তি প্রকাশ করেননি খাত সংশ্লিষ্টরা। ইন্টারনেট ও অনলাইন কেনাকাটায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ার শঙ্কা করছেন তারা।
এ বিষয়ে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে এখন বাসায় বসেই অনলানইনে মানুষ কেনাকাটা করছে। মানুষ ঘরে বসে অফিস করছে। ব্যবসা করছে অনলাইনে। শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে অনলাইনে। তাই ইন্টারনেটের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের জনজীবনের স্বাভাবিকভাবে একটা প্রভাব পরবে। যেহেতু মানুষের আয়-ক্ষমতা করোনাকালে কমে গেছে। তাই অনলাইন ডেলিভারিতে খরচ না কমালে এবং ইন্টারনেট ব্যয় বাড়লে; ই-কমার্স খাতও বাধাগ্রস্ত হবে।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, মোবাইলের সিম কার্ডের ওপর ১০ শতাংশ ডিউটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় মোবাইল পেনিট্রেশন বাধাগ্রস্ত হবে। এছাড়াও বিদেশ থেকে রাউটার সহ অন্যান্য যেসব নেটওয়ার্কিং ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করে থাকি, সেগুলোর ওপর অনেক ডিউটি রয়েছে, এগুলো কমিয়ে দেয়া দরকার। কেননা, এখন আমাদের অবকাঠামো গঠনের সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো দিক-নির্দেশনা পাইনি।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের বাইরে প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে মূল্য়ায়ণ জানতে চাইলে আইসিটি সাংবাদিকদের সংগঠন বিআইজেএফ সভাপতি মোঃ মোজাহেদুল ইসলাম বললেন, লাস্ট মাইল ব্রডব্যান্ড নিয়ে বাজেটে কোনো নির্দেশনা না থাকায় আগামী ডিজিটাল বৈষম্য আরো বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, প্রতি ১০ শতাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পেনিট্রেশনের মাধ্যমে ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটে। আর প্রতি ১ হাজার ব্রডব্যান্ড সংযোগের মাধ্যমে প্রায় ১০ জন কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বিষয়টি বাজেটে উপেক্ষিত থেকেছে।