ভূমিকম্পের অন্তত মিনিট পাঁচেক আগে মোবাইল ফোনে জরুরী সঙ্কেত দিতে সক্ষম একটি প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার মডেল বানিয়েছে দেশের তিন তরুণ উদ্ভাবক। ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের এইচএসসি (বিজ্ঞান) দ্বিতীয় বর্ষের তিন সহপাঠী হলেন- রনৎ দাস প্রাঙ্গন, নাহিদ হাসান শুভ ও সাজিদ হাসান নাঈম। এই স্মার্টফোন অ্যাপ টেকনোলোজির সেন্সরের সমন্বয়, ডাটা প্রসেসিং, হার্ডওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ের কাজটি করেছেন প্রাঙ্গন। রিয়েলটাইম সার্ভারের সাথে কানেক্টেড অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট করেছে নাঈম এবং ভূমিকম্প সংক্রান্ত যাবতীয় ডাটা মাইনিং ও গবেষণার কাজ করেছে শুভ। দেশের পেক্ষাপটে তাদের উদ্ভাবিত এই ভূমিকম্প সতর্কীকরণ ব্যবস্থাটি তাদেরই ডেভেলপ করা ‘আভাস’ নামে স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর কাছে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পৌঁছে দেবে।
‘আভাস’ কি?
এটি একটি ভূমিকম্প সতর্কীকরণ ব্যবস্থা যা একটি স্মার্টফোন অ্যাপ টেকনোলোজি। কিছু সেন্সর ও একটি রিয়েলটাইম সার্ভারের সমন্বয়ে তৈরি। ভূমিকম্প আঘাত করার প্রায় ৬০ থেকে২ ০০সেকেন্ড (স্থান ভেদে)পূর্বেই এটি ইউজারের ফোনে নোটিফিকেশন ও এলার্ম দিতে সক্ষম।এর পাশাপাশি প্রলয় সৃষ্টিকারী সেকেন্ডারি আসার একটি কাউন্টডাউন শুরু হবে এবং ভূমিকম্পের সতর্কতা মূলক বিভিন্ন উপদেশ পাওয়া যাবে।
অর্থাৎ মোট ২টি সেন্সর, ১টি অ্যাক্সিলেরোমিটার এবং আরেকটি জিরোস্কোপ ব্যবহার করে যেকোনো ধরণের সিসমিক তরঙ্গের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা কত হতে পারে তার আগাম আভাস দিতে সক্ষম তোমাদের এই সিস্টেমটি। আর এ জন্য একটি রিয়েল টাইম সার্ভারের সহায়তা নিচ্ছে তারা। উদ্ভাবনের ল্যাব পরীক্ষায় উদ্ভাবকরা দেখেছেন, গত কয়েকটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের সবগুলোরই উৎপত্তি স্থল ছিলো বাংলাদেশের বাইরে। তাই দেশের সীমান্তবর্তী সম্ভাব্য ২৫টি অঞ্চলকে এই সিস্টেম এর আওতাভুক্ত না করা হলে দেশে এর বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব না।
এ বিষয়ে কিশোর উদ্ভাবক দলের প্রধান প্রাঙ্গন বলেন, আমাদের সব আয়োজন শেষ। আমরা seismic wave simulation এর মাধ্যমে পরীক্ষা চালিয়েছি এবং শতভাগ সফলতা পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও আমরা এবারের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় অংশ নিয়ে জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম হই এবং জাতীয়তে ৫ম হয়েছি। প্রতিটি আসরেই পরীক্ষাটি চালানো হয়। সেখানে বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচারকম-লীর উপস্থিতিতে আমরা আমাদের প্রকল্প উপস্থাপন করেছি। তারা আমাদের কাজকে প্রশংসিত করেছেন।
তাহলে অ্যাপটি কেন সবার জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের সেন্সরগুলো স্থাপনের জন্য ২৫ টি সংরক্ষিত জায়গা দরকার সে জয়গা না পাওয়া পর্যন্ত এটা আমরা পাবলিক করতে পারছি না। এ পর্যায়ে আমাদেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা জরুরী। যা পাওয়া মাত্রই আমরা implementation-এ জেতে পারবো।
কীভাবে কাজ করবে আভাস ?
উদ্ভাবকরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের কম্পন অনুভব করার জন্য কিছু সেন্সর মাটির নিচে স্থাপন করা হবে। এই সেন্সরগুলো একটি রিয়েল টাইম সার্ভারের সাথে যুক্ত থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় তারা একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভেলপ করেছেন যা সার্ভার থেকে ডাটা সংগ্রহ করতে পারবে এবং সংগ্রহকৃত ডাটার উপর ভিত্তি করে নোটিফিকেশন ও এলার্ম দিতে পারবে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্প সাধারণত টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে হয়ে থাকে। এই সংঘর্ষের সময় প্রধানত দুই ধরনের ওয়েভ উৎপন্ন হয়। এদের মধ্যে প্রাইমারি ওয়েভের বেগ সবচেয়ে বেশি। তারপরেই আসে সেকেন্ডারি ওয়েভ। যার বেগ প্রাইমারি ওয়েভের প্রায় অর্ধেক কিন্তু অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। ভূমিকম্পের মূল ক্ষতিসাধনকারী ওয়েভ এটিই। প্রাইমারী ওয়েভ সাধারণত ক্ষতি করে না। অনেক সময় অনূভবই করা যায় না। যদি সেন্সরগুলোর মাধ্যমে প্রাইমারি ওয়েভ শনাক্ত করা যায় তাহলে সাথে সাথে অ্যাপের মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে সেকেন্ডারি ওয়েভ আসার পূর্বেই তারা কিছু বাড়তি সময় পাবেন নিজেদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেকেন্ডারি ওয়েভটি আসার আগে যে সময় পাওয়া যাবে সেই সময়টি নির্ভর করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং জনগণের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। অ্যাপটির মাধ্যমে হাতে থাকা সর্বনিম্ন সময় দেখা যাবে একটি কাউন্টডাউন আকারে।
দেশের জন্য দেশেই উদ্ভাবিত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সংক্রান্ত এই প্রযুক্তি সেবাটির প্রয়োগ পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা দলের অপর সদস্য সাজিদ হাসান নাঈম বলেন, দেশের সীমান্তবর্তী ২৫টি অঞ্চলকে এই সিস্টেমের আওতাভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরীণ ফল্টলাইনের কথা বিবেচনা করে আরও পাঁচটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। যখন যেখান থেকে ভূমিকম্পের সিগনাল পাবে ‘আভাস’ নামের এই র্স্মাট ফোন অ্যাপ, সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনের এলার্ম বেজে উঠবে। এজন্য প্রতিটি সেন্সর তৈরিতে খরচ পরবে মাত্র এক হাজার টাকা এবং সিস্টেমটি স্থাপন করতে খরচ পরবে সাড়ে সাত হাজার টাকা।
তিনি বলেন, উৎপত্তি স্থল থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যদি সেন্সরগুলোর মাধ্যমে প্রাইমারি ওয়েভ শনাক্ত করা যায় তাহলে সাথে সাথে অ্যাপের মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে সেকেন্ডারি ওয়েভ আসার আগেই সাধারণ মানুষ কিছু বাড়তি সময় পাবেন নিজেদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেকেন্ডারি ওয়েভটি আসার আগে যে সময় পাওয়া যাবে সেই সময়টি নির্ভর করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং জনগণের অবস্থানের উপর।
খরচের মধ্যে মাটির চাপ ও তাপ মাত্রার তথ্য নিতে অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেম তৈরি করতে খরচ হবে ১,৫০০ টাকা, সেন্সর তৈরিতে খরচ হবে ১,০০০ টাকা, খনন কাজে খরচ ৫,০০০ টাকা ধরা হলেও পেটেন্ট, সার্ভার ভাড়া এবং অ্যাপের জন্য কোনো খরচ ধরা হয়নি।
এদিকে কিশোর উদ্ভাক দলের আরেক সদস্য সাজিদ হাসান নাঈম জানালেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের নিকটবর্তী আমাদের সীমান্তবর্তী স্থলের বিভিন্ন পয়েন্টের ৩০ মিটার নিচে সেন্সর স্থাপন করা হবে। অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের মাধ্যমে মাটির চাপ ও তাপ মাত্রা সংগ্রহ কওে সংশ্লিষ্ট স্থানের টাওয়ার হয়ে জিপিএস পদ্ধতিতে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তা অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাবে।
এমন উদ্ভাবনের প্রশংসা করে ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের লেকচারার শ্রাবন্তী দত্ত বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রিসার্চ ভিত্তিক পড়াশোনা হয়। আমাদের কোর্সভিত্তিক পড়াশোনার মাঝেও যে আমাদের শিক্ষার্থীরা এ রকম উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাচ্ছে, সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
এই উদ্ভাবন কতটা ফলপ্রসূ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি দেখতে চাই এটা কতখানি কাজ করবে সেজন্য আমাদের ইমপ্লিমেন্ট পর্যন্ত যেতে হবে। তবে যতটুকু পর্যন্ত তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে তাতে আমরা ৩-৪ মিনিটের মধ্যে একটা সতর্কবার্তা পেয়ে যাব। কিন্তু কথা হচ্ছে এই সময়ের মাঝে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা কমাতে পারবো। এটার আরও কিছু ইম্প্রুভ করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট তাদেরকে করতে হবে।