বাস্তবে না থকলেও মেটাভার্সের ভার্চুয়াল জগতে বিক্রি হচ্ছে জমি। অবাক মনে হলেও এই অস্পৃশ্য সম্পত্তি কিনতে পিছিয়ে নেই ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ব্র্যান্ডগুলো। গত ১২ মাসে ভার্চুয়াল জমি কিনতে ১৯৩ কোটি ডলার খরচ করেছেন আগ্রহীরা।
এদেরই একজন যুক্তরাজ্যের অ্যাঞ্জি টমসন। দেড় হাজার পাউন্ড দিয়ে তিনি তার প্রথম মেটাভার্স পার্সেল কিনেছিলেন ২০২০ সালের জুলাই মাসে। এখন তার ডিজিটাল জমির আকার তুলনা বিচারে বাস্তবের একটা ছোট পরিবারের থাকার উপযোগী জমির সমান। ভার্চুয়াল দালানগুলোর সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা তিনতলা দালানের সমান। ছাদের বারান্দায় সাদা-কালো রঙের দাগ টেনে রাস্তা পার হওয়ার জায়গা করে রেখেছেন টমসন। মজা করে একটি গোলাপী রঙের ট্রাক্সিও রেখেছেন সেখানে। কোনো কারণ বা যাত্রী ছাড়াই যাওয়া-আসা করতে থাকে সেই ট্যাক্সি। টমসনের ভাষায়, “কি বোর্ডের এফ কি চেপে ধরে উড়ে উড়ে আমার পুরো পাড়া ঘুরে দেখতে পারবেন আপনি।”
তবে কেবল আমোদ-প্রমোদে নয় মেটার ওই ভার্চুয়াল জমিতে এরই মধ্যে ডিজিটাল শিল্পকর্মের দুটি গ্যালারি বানিয়েছেন তিনি। ‘ভক্সেলস’ মেটাভার্সের ওই গ্যালারিগুলো থেকে টমসন তার ডিজিটাল শিল্পকর্ম বিক্রি করছেন ক্রিপ্টো মুদ্রার বিনিময়ে।
বাণিজ্যিক কাজে, অনলাইনের ডজন খানেক মেটাভার্সের মধ্যে আলাদা জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘ডিসেন্ট্রাল্যান্ড’। এ প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে। সেখানে ভার্চুয়াল জমির পার্সেল বিক্রি হচ্ছে হাজার ডলারে, কখনো বা কয়েক মিলিয়ন ডলার দামে। এখানে ক্রেতার তালিকায় আছে স্যামসাং, ইউপিএসের মতো বাণিজিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে ভার্চুয়াল দোকান চালু করার পাশাপাশি ভিজিটর সেন্টারও চালু করেছে কোম্পানিগুলো।
ডিসেন্ট্রাল্যান্ডে চারটি ফুটবল মাঠের সমান জমির মালিক বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘ফিলিপ প্লাইন’। ভার্চুয়াল জমিতে দোকান ও গ্যালারি খোলার পরিকল্পনাও করেছে এ কোম্পানি। কিন্তু দেড় কোটি ডলার খরচ করে ভার্চুয়াল জগতে জমি কেনার বিষয়টি নিজের মায়ের একেবারেই পছন্দ হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্র্যান্ড মালিক ফিলিপ প্লাইন। এক বছরের বেশি সময় ধরে ২৪টি ভিন্ন ভিন্ন ক্রিপ্টো মুদ্রার বিনিময়ে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন প্লাইন। ২০২২ সালে শুরুতেই লন্ডনের ওল্ড বন্ড সড়কে নতুন দোকান খুলেছেন তিনি। সে দোকানে পোশাক আর ‘নন-ফাঞ্জিবল টোকেন’ বা এনএফটি বিক্রি করছেন ব্রিটিশ পাউন্ড আর বিটকয়েন ও ইথেরিয়ামের মতো ক্রিপ্টো মুদ্রার বিনিময়ে।
তবে বছর জুড়ে ক্রিপ্টো বাজারে মন্দার প্রভাব পড়েছে ভার্চুয়াল জমির বাজারেও। বাণিজ্যিক প্রচারে এ ভার্চুয়াল জগৎ অবসর বিনোদন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর পেশাদারী কাজের গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রযুক্তি বোদ্ধাদের মতে, সে অনেক দূরের পথ।
প্রযুক্তি বাজারের বিশ্লেষক ‘ড্যাপ রেডার’-এর সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, গত ১২ মাসেই ভার্চুয়াল জমি কিনতে ১৯৩ কোটি ডলারের ক্রিপ্টো মুদ্রা খরচ করেছেন আগ্রহীরা। এর মধ্যে দুই কোটি ২০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ভার্চুয়াল জমি বা পার্সেল বিক্রি করেছে ভক্সেল। ড্যাপ রেডারের তথ্য বলছে, গত এক বছরের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বাজে দশায় পড়েছে ডিজিটাল রিয়েল এস্টেট বাজার।
তারপরও মেটাভার্সে জমি কিনেছে অ্যাডিডাস, আতারি, ইউবিসফট, বাইন্যান্স, ওয়ার্নাল মিউজিক এবং গুচির মতো বহুল পরিচিত কোম্পানিগুলো। গেইমিং মেটাভার্স রোব্লক্সেও উপস্থিতি আছে গুচির। ভার্চুয়াল জগতে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে এক বছরে তিন কোটি ৬০ লাখ দর্শনার্থী পেয়েছে ‘গুচি টাউন’। অন্যদিকে ১১ মাসে দুই কোটি ৫০ লাখ দর্শনার্থী পেয়েছে ভার্চুয়াল নাইকি ল্যান্ড। গাঁটের পয়সা খরচ করে গুচি ল্যান্ডে নিজের অ্যাভাটারের জন্য পোশাক কিনতে পারেন দর্শনার্থীরা। আর গেইম খেলে আয় করা পয়েন্টের বিনিময়ে অ্যাভাটারের জন্য টি-শার্ট আর জুতো বেচে নাইকি ল্যান্ড।
বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, বয়সে তরুণ মেটাভার্সগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে রোব্লক্স, মাইনক্র্যাফট ও ফোর্টনাইট। এই গেইমিং প্ল্যাটফর্মগুলো ভার্চুয়াল জমি বিক্রি করছে না, নেই কোনো ব্লকচেইন সমর্থন। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের মেটাভার্সের মূল উপাদানের অনেক কিছুই প্ল্যাটফর্মগুলোতে উপস্থিত। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে গেইম খেলার পাশাপাশি আড্ডা দেওয়ার সুযোগ আছে গেইমারদের। নিজস্ব অভ্যন্তরীণ মুদ্রা ব্যবস্থা আছে প্ল্যাটফর্মগুলোর, আছে অর্থ আয়ের সুযোগ। সবচেয়ে ইতিবাচক বিষয় হল, ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ব্লকচেইন বা ক্রিপ্টো মেটাভার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর চেয়ে অনেক বেশি এই গেইমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর।
যদিও নিজস্ব মেটাভার্স প্রকল্পের পেছনে এক বছরে এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল কোম্পানি মেটা। কিন্তু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বলছে, প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারের আগ্রহ নেই খোদ কোম্পানির কর্মীদের মধ্যেই।