নিজেদের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় বাংলাদেশে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ ভিডিও মুছে ফেলেছে ইউটিউব। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে ব্যবহারকারীদের মতামতও মুছে ফেলেছে ভিডিওর এই স্ট্রিমিং সাইটটি।
এ নিয়ে নিরপেক্ষ এবং অরাজনৈতিক অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে জানানো হয়, উগ্রবাদিতা, নগ্নতা এবং স্প্যাম ভিডিও প্রচার এবং শিশুবান্ধব না হওয়ার কারণে এসব ভিডিও ও মতামতগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, উল্লেখিত সময়ে সারাবিশ্বের প্রায় ৯০ লাখের বেশি ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে। সব থেকে বেশি ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। এ ছাড়া এই সময়ে ইউটিউব থেকে ২০ কোটির বেশি ইউটিউব চ্যানেলও মুছে ফেলা হয়।
যেসব কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘনের জন্য ভিডিও সরানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক কনটেন্ট- যার হার ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ। সহিংসতা ছড়ানো বা তাৎক্ষণিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকায় কনটেন্টগুলো অপসারণ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
সবচেয়ে বেশি সরানো হয়েছে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে এমন ভিডিও। এর হার ছিল ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ। শিশুদের হয়রানি ও তাদের কেন্দ্র করে নানা অনলাইন অপব্যবহার রোধে ভিডিওগুলো সরানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এক বছরে বাংলাদেশের ৬ লাখ ৩৮ হাজার ভিডিও অপসারণ
গুগল ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আপলোড হওয়া ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪৪০টি ভিডিও অপসারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ১৫ হাজার ৯০৭টি ভিডিও সরায় প্ল্যাটফর্মটি। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে ভিডিও অপসারণের হার বেড়েছে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, ইউটিউবে বাংলাদেশের বেশ কিছু চ্যানেলে ভুয়া তথ্যবহুল কনটেন্ট পোস্ট করার পর থেকে তাদের ভিউ ও সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বেড়েছে এবং এসব ভুয়া কনটেন্টে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হওয়ায় তা থেকে ইউটিউবও মুনাফা অর্জন করছে।
আর অন্যদিকে তৃতীয় যে শ্রেণির ভিডিও সরানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি সেগুলো ছিল হিংসাত্মক বা গ্রাফিক কনটেন্ট। এর হার ছিল সাড়ে সাত শতাংশ। মানুষের মনে আতঙ্ক বা উদ্বেগ ছড়াতে পারে এমন সংবেদনশীল দৃশ্য যেমন দাঙ্গা, রক্তপাত ইত্যাদিকে হিংসাত্মক বা গ্রাফিক কনটেন্ট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ইউটিউব।
এর আগেও ইউটিউব এমনভাবে তাদের নীতিমালা লঙ্ঘনের জন্য ভিডিও এবং চ্যানেল মুছে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এ তিন মাসে ৮৩ লাখ ভিডিও মুছে ফেলেছে। ওই বছর কমিউনিটি নীতিমালা না মানায় এসব ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছিল বলে তখনকার ত্রৈমাসিক ‘এনফোর্সমেন্ট প্রতিবেদন’-এ উল্লেখ করেছিল ইউটিউব কর্তৃপক্ষ।
ওই সময় ইউটিউব কর্তৃপক্ষ জানায়, যৌনতাপূর্ণ ভিডিও সরিয়ে ফেলতে ইউটিউব ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তিন মাসে ৯১ লাখ অনুরোধ পেয়েছিল ইউটিউব কর্তৃপক্ষ। ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য বা অবমাননাকর ভিডিও পোস্টের অভিযোগ পেয়েছিল ৪৭ লাখ। এসব অভিযোগের বেশির ভাগ এসেছিল ভারত, যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিল থেকে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসেও ইউটিউব এভাবে ভিডিও সরিয়ে ফেলার কাজ করেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসের মধ্যে ১০ লাখ ৮০ হাজার ভিডিও ইউটিউবের ভারতীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে সরানো হয়েছে। এ ছাড়া আমেরিকার ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৬৮, রাশিয়ায় ৪ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৩ এবং ব্রাজিলের ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫৯টি ভিডিও সরিয়েছিল ইউটিউব।
ওই সময়ে ইউটিউব ৬.৪৮ মিলিয়নের বেশি ভিডিও তার প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়েছে কমিউনিটি গাইডলাইন ভাঙার অভিযোগে।
ইউটিউব ব্যক্তিমানুষ ও মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এই দুইয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে নীতিমালা লঙ্ঘনের বিষয়গুলো যাচাই করে। তবে মুছে ফেলা ভিডিওগুলোর প্রায় ৯৬ শতাংশের ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত এআই নিয়েছে। বাকি ৪ শতাংশ ভিডিও অপসারণে ইউটিউবের সাধারণ ব্যবহারকারী ও ‘প্রায়োরিটি ফ্ল্যাগার প্রোগ্রামের’ বা কমিউনিটি সদস্যদের অভিযোগ বা পরামর্শ বিবেচনা করে তা করা হয়েছে বলে জানা যায়।
গত বছর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আপলোড করা ৪২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৩টি ভিডিও মুছে ফেলেছিল টিকটক। ভিডিওগুলো টিকটকের নীতিমালা (কমিউনিটি গাইডলাইন) লঙ্ঘন করাসহ ভুল তথ্যের প্রচার ঠেকানোর পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের অনলাইনে নিরাপদ রাখতে তা মুছে ফেলা হয়েছে বলে জানায় টিকটক। ওই সময়ে টিকটকের প্রকাশিত সর্বশেষ ‘কমিউনিটি গাইডলাইনস এনফোর্সমেন্ট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে ৯ কোটি ১০ লাখ ৩ হাজার ৫১০টি ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে, যা প্ল্যাটফর্মটিতে আপলোড করা ভিডিওর প্রায় দশমিক ৬ শতাংশ। এই ভিডিওগুলোর মধ্যে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯১১টি ভিডিও স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে মুছে ফেলা হয়েছে। তবে যাচাইয়ের পর ৬২ লাখ ৯ হাজার ৮৩৫টি ভিডিও পুনরায় টিকটকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
ভিডিও মুছে ফেলার পাশাপাশি ১৩ বছরের কম বয়সি ব্যবহারকারী সন্দেহে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ৬৯ লাখ ৪৭ হাজার ৪৮৪টি অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেছি টিকটক।
একই সময়ে ৫ কোটি ১২ লাখ ৯৮ হাজার ১৩৫টি ভুয়া অ্যাকাউন্টও মুছে ফেলা হয়েছিল। ভুল তথ্যের প্রচার রোধ এবং অনলাইনকে নিরাপদ করতেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে তখন জানিয়েছিল টিকটক কর্তৃপক্ষ।