ড. মনযুরুল হক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান। তার একটি ডাকে একত্র হয়েছিলো সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশী। স্বাধীনতার আকঙক্ষায় ঝাপিয়ে পড়েছিলো পুরো জাতি। বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নন; তিনি নিজেই ক্রিয়া। তিনি হলেন বাংলাদেশের ডিএনএ এবং ডিএনএর মতোই তাঁর মানসিকতা নির্দেশ দেয়- বাংলাদেশের বিকাশ, বেঁচে থাকা এবং সকলের জন্য ন্যায়, মানবতা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে কী প্রয়োজন তা পূরণ করার শক্তি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, কিভাবে বাংলাদেশ দারিদ্র্য দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। কোনো কোনো হিসেব অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে; অর্থাৎ এখন থেকে মাত্র বিশ বছর পর।
আর এটা সম্ভব হয়েছে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে; বঙ্গবন্ধুর ভিশন ও নীতি নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, জঙ্গিবাদ নির্মূল, অসংগঠিত অবস্থান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, দারিদ্র্য দূরীকরণে তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এখন দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আমার হিসেব অনুাসারে আগামী ১২ বছরে ৬ শতাংশ নিয়মিত প্রবৃদ্ধি হাৱে ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “একজন মানুষ হিসাবে, মানবজাতির যে কোনো উদ্বেগের বিষয় আমাকে উদ্বিগ্ন করে। একজন বাঙালী হিসেবে, আমি বাঙালিদের উদ্বেগজনক সমস্ত কিছুর সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই চিরস্থায়ী সম্পৃক্ততা, ভালবাসা থেকে উৎসারিত এবং লালিত স্থায়ী ভালবাসা, যা আমার রাজনীতি এবং আমার অস্তিত্বকে অর্থবহ করে।” উদ্ধৃত এই অংশটুকুতে ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর মানসিকতা যা প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর দেশপ্রেমের উৎস থেকে। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুতভা। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি-“সবার প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়”। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের আইকনিক তথা অপরিমেয় অতিথিপরায়ণ ও প্রতিক্রিয়া, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, তৈরি পোশাক খাতে শিল্প ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সে বাংলাদেশের সাফল্যের ইতিহাস, ডিজিটাল ডিসরাপশন এই ফ্রন্টের ধারাবাহিকতার কিছু উল্লেখযোগ্য দিক। ডিজিটাল রূপান্তর, পারমাণবিক শক্তি এবং মহাকাশ প্রযুক্তির যুগে একটি আলোকবর্তিকা যা অনুপ্রেরণাদায়ক ও উৎসাহবর্ধক এবং বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
যতদিন ধরণীতের ভালবাসা আছে; ভালবাসা থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা শুধু মাতৃভূমিতে নয়, বিশ্বে অব্যাহত থাকবে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন লিখেছেন, “ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার না করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী ডায়গনিস্টিক মানদণ্ড আজ খুব ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক। যেহেতু এটি বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ – শুধু বাংলার জন্য নয়, তাই বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসাবেও দেখা যেতে পারে।”
বঙ্গবন্ধু এমন এক কিংবদন্তির নাম যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি বুভুক্ত ও দারিদ্রমুক্ত সমৃদ্ধ দেশের। তার কর্মগুলো পৃথিবীকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। এবার তাঁৱ বড় মেয়ে বিশ্ববন্ধুর বন্ধুতভা দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার পালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজকের প্রত্যাশিত বিজয়, বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ববন্ধুর আদর্শকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা জাগরিত করবে, তাদেরকে মানবিক মূল্যবোধ শিখতে এবং নিজস্ব জাতি ও বিশ্বের প্রতি ভালোবাসা জানাতে অনুপ্রাণিত করবে। এটি তাদের বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ও চেতনা গ্রহণের সুযোগও দেবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্ব অভূতপূর্ব উন্নতি করছে। বঙ্গবন্ধু এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে দেশের তরুণ-তরুণীরা শুরু থেকেই সঠিক ও প্রাসঙ্গিকভাবে শিক্ষিত হয়ে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। তাই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬শে জুলাই ডক্টর কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি স্বাধীন আধুনিক শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। হায়েক আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাজারের প্রবক্তা যথার্থই বলেছেন, “আর্থিক বাজার হল একটি স্থিতিশীল সামাজিক শৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একমাত্র বৈধ, নির্ভরযোগ্যভাবে কল্যাণ-বর্ধক ভিত্তি।” সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফিনটেক নতুন উচ্চতায় উঠে এসেছে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে। ফিনটেক ইকোসিস্টেম প্রত্যাশিত বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন আনবে। ফিনটেক ও এআই ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি ২০ ট্রিলিয়ন ডলাৱ বাড়াতে পারে৷
নিরাপত্তা, কানেক্টিভিটি এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সমৃদ্ধির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইন্দো প্যাসিফিক করিডোর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (IOR) বাংলাদেশের বর্ধিত ভূমিকার কারণে বিশ্ববন্ধুর বন্ধুতভা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাসঙ্গিক। গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে একটি টাউন হল বৈঠকে, রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশে চারটি পরাশক্তির সম্পৃক্ততা রক্ষায় দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার এক দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ! বর্তমান রাজনৈতিক দাবা খেলায় যখন ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, আমাদের বুঝতে হবে সেখানে ভারতকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছিল যাতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে প্রভাব বলয় গঠন করা যায় এবং গ্রুপ থেকে শ্রীলঙ্কা ও নেপালকে হারানোর জন্য সংশোধন করা হয়।[1] বাংলাদেশ এখন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই স্বাভাবিক অংশীদার। প্রভাবের একটি নতুন বলয় অর্জনের জন্য আমাদের তাদের সাথে কাজ করতে হবে। যখন এই দাবা খেলার ধ্রুম্রজালটি সরে যাবে তখন স্পষ্ট হবে কল্পিত হাতির কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ ছাড়াই এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে।
পিতা শেখ মুজিব ও অমর বঙ্গবন্ধুকে ও বিশ্ববন্ধুকে সম্বোধন করে আমি আমার লেখা শেষ করতে চাই। এক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কয়টি পঙক্তি উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্থপতি এবং অদম্য ত্রাণকর্তার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই।
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা–
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
[…] সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
Where the mind is led forward by thee
Into ever-widening thought, action, and joy.
My Father, wake my country into that heaven of freedom.
জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বিশ্ববন্ধু, জয় বাংলা।
লেখক : অধ্যাপক, সেইন্ড যেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়, সিকাগো
[1] আমি জুন থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করছি এবং 2023 সালের আগস্টের শুরুতে গ্রুপ অফ অ্যাকাডেমিকস এবং টুইটার নেটওয়ার্কে লিখেছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফর এবং ভিসা বিধিনিষেধের পরপরই আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার বাংলাদেশ ও ভারত সফর এবং এক্স-এ মাইকেল কুগেলম্যানের প্রতিক্রিয়া আমার দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করেছে।
দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়েই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেই সংক্ষুবদ্ধ বা উদ্বেলিত হলে তা তার একান্ত বিষয়।