গত ৫ জুলাই ‘এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই) বিল-২০২৩’ সংসদে উত্থাপন করেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক এমপি এবং বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে এই প্রথমত এই আইন নিয়ে আইসিটি খাতের নেতাদের আপত্তি এবং পরে কিছু ধারায় তাদের মতামত দিয়ে সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ৫টি আইসিটি ট্রেড এসোসিয়েশন এর নেতারা। তারা আইনের খসড়া পর্যায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়েছেন। আইনের যেসব জায়গায় খাত সংশ্লিষ্টদের আপত্তি রয়েছে তা তারা উদ্বেগের সহিত জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী এই বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। এতে ডিজিটাল খাতের ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন বটে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা দেল ভিন্নচিত্র, আইনটি যখন পাস হয়। তখন দেখা যায় ব্যবসায়ীদের মূল আপত্তির বিষয়সহ কয়েকটি জায়গায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। যা আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল তাতেই আইনটি সংসদে পাস করা হয়। সরকারের উচ্চ পদস্থদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং তাদের আশ্বাস সত্বেও উদ্যোক্তাদের দাবী দাওয়ার কোনো প্রতিফলন না ঘটায় তারা বেশ হতাশ হয়েছেন। তাদের হতাশার কথা তারা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সকলকে জানিয়েছেন। তারা এখনো আশা করেন সরকার এটি সংশোধন করবে।
বাস্তবতার উপলব্ধিতে এমন আশার গুড়ে বালি পড়ার আশংকাই বেশী। প্রথমত তাদের প্রবল আপত্তি সত্বেও বিলটি সরকারের সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিরা যেভাবে প্রস্তাব করেছেন সেভাবেই পাশ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের এই স্বল্পকাল বাকী থাকা সময়ে সরকার আরো অনেক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সহসা এর কোনো সুরাহা হবে না।
বিশেষ করে- এটুআই আইনের ১৬ ধারায় বলা আছে, সংস্থা হিসেবে সেবা বা পরামর্শ দেওয়ার বিনিময়ে ফি নিতে পারবে এটুআই। এ ছাড়া ২১ ধারায় আছে সংস্থা হিসেবে এটুআই প্রয়োজনে কোম্পানি গঠন করতে পারবে। এরকম কয়েকটি বিষয়ে আইসিটি খাতের উদ্যোক্তাদের আপত্তি থাকলেও এই দুটি বিষয়ে ছিল জোরালো দ্বি-মত।
প্রথমত, বেসরকারী খাত যে কাজটি করে থাকে সে একই কাজ সরকারী কোনো এজেন্সি করুক এটা তারা চাননা দ্বিতীয়ত তাদের মতে, আরো একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সরকার সমজাতীয় কাজ বা ব্যবসা করে তাদের প্রতিযোগী হোক এটাও তাদের চাওয়া নয়। এই বিষয়টি বোঝাতে ৫টি আইসিটি এসোসিয়েশন এর নেতারা যৌথ চিঠি দিয়েছেন এবং বিষয়টি মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
সহজ কথায় তারা আশঙ্কা করছেন এই প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানী আকারে প্রতিষ্ঠিত হলে তারা অসম প্রতিযোগিতায় পড়বেন। সংস্থাটি তাদের ব্যবসায় ভাগ বসাবে। আরো সহজ করে বললে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা আইসিটিতে সরকারের যেসব কাজ করেন সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হবেন অনেকাংশেই। কারণ বাংলাদেশে আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে সরকারী কাজ করার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশবিশেষের নির্ভরশীলতাও তৈরী হয়েছে।
বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারে তবে আশংকা অমূলক নয়। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ঠ কর্তাব্যক্তিরা ব্যবসায়ীদর আশংকার সাথে একমত নন। তারা মনে করেন এটুআই কোম্পানী হলে বা নিজেরা কোম্পানী গঠন করলেও আইসিটি খাতের সিংহভাগ কাজ বেসরকারী খাত থেকে সহযোগিতার আদলে করার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্নক্ষেত্রে সরকারী কোম্পানী প্রতিষ্ঠার নজির রয়েছে। কিন্তু তাতে করে সেসব খাতে বেসরকারী খাতের ব্যবসায়িক স্বার্থহানি ঘটেনি। শুধুমাত্র ব্যাংক ব্যবস্থার দিকে তাকালেও এমনটা সহজে অনুধাবন করা যায়।
যে পাঁচটি সংগঠন ধারাগুলো নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস),ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) , ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো),এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)।
আইনের অধ্যায় ৫ এ বলা হয়েছে- ‘‘এজন্সেরি ক্ষমতা ও র্কাযাবলি। ১) এই আইনরে উদ্দশ্যেপূরণকল্প, এজন্সেরি ক্ষমতা ও র্কাযাবলি হইবে নিন্মরূপ, ….ঘ) প্রযুক্তভিত্তিকি উদ্ভাবনী র্কমসূচী ও প্রকল্প গ্রহণ; ঙ) অংশীদারীত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার, শিল্প, শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজরে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশাসহ দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানসমূহকে সেবা ও পরার্মশ প্রদান;।’’ এখানেও ব্যবসায়িক প্রতিযোগি হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে। আর এটাই হয়েছে খাত সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগের কারণ।
খাতসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো- দেশী বিদেশী সরকারি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারী খাত থেকে সেবা দেয়া হচ্ছে এবং দেয়া হবে। সরকার বা সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ ব্যবসা করা নয়; এমনকি যেসব বেসরকারী খাত উন্নত বা উন্নত হতে চলেছে তাদের ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠান এসে ব্যবসা করা কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকার উদ্যোক্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না।
অনুচ্ছেদ ১২ (১) তে বলা হয়েছে- (১) ‘‘এই আইনরে উদ্দশ্যে পূরণকল্পে নির্বাহী কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি হইবে নিন্মরূপ, যথা:-(ক) প্রকল্প, র্কমসূচি ও পরকিল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ; (ঘ) ব্যক্তি, ফার্ম কোম্পানি, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহিত যৌথ উদ্যোগ বা অংশীদারি কারবারে অংশগহণ; এবং——।’’
উপধারা (খ) বলা হয়েছে- ‘‘এজেন্সির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার, উহার বীমাকরণ ও বীমা পরচিালনা; (গ) এজেন্সির কল্যাণে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বা উহার কোনো অংশ ইজারা বা ভাড়া প্রদানের অনুমোদন;। ’’ এই বিষয়ে আপত্তির কারণ হলো বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন এই বিষয়ে এটুআই শুধুমাত্র গবেষণার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকুক। যদিও এ ধরনের কার্যক্রম সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিতেও রয়েছে। এই বিষয়ে উদ্যোক্তারা তাদের মতামত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে ১৮ জুন সংসদীয় কমিটির সভায় ব্যাখ্যাসহ মতামত তুলে ধরে আইসিটি খাতের বাণিজ্য সংগঠনগুলো।
বিলের ধারা ২১ মতে, কোম্পানি গঠনরে ক্ষমতা। এই আইনের উদ্দেশ্য পুরণকল্পে এজেন্সি প্রয়োজন অনুযায়ী কোম্পানি গঠন করতে পারবে। আর এটাই মূলত বেসরকারী খাতের মূল আপত্তির জায়গা। সরকারী কিছু ব্যত্তিগণ এই বিষয়ে এই ধারণা পোষণ করেন যে, যেহেতু এ ধরনের ব্যবস্থা আরো কিছু বিরলক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে তাই এখানেও এটা করা যেতে পারে।
ধারা ২২ এ ক্ষমতা র্অপণ বিষয়ে বলা হয়েছে ‘‘ পরচিালনা র্পষদ, প্রয়োজনে, ইহার কোনো ক্ষমতা, লিখিত আদশে দ্বারা ও নির্ধারিত র্শত সাপেক্ষে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, অন্য কোনো সদস্য, র্কমচারী বা কোনো কমিটিকে র্অপণ করিতে পারিবে। ‘’ এই ধারাটি নিয়েও অনেকে শংকিত। কারণ এখানে পরিচালনা পর্ষদের কতটুকু ক্ষমতা কোন পর্যায়ে অর্পণ করা যাবে তা বলা নেই। এমনকি কোন ধরনের ক্ষমতা তাও উল্লেখিত নেই। এই অবস্থায় কোনো নির্বাহী ক্ষমতা, আর্থিক ক্ষমতা কোনো কর্মচারীকে প্রদান করা হলে সেখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ থাকবে কিনা এই প্রশ্নটি থেকে যায়।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর বরাতে সংবাদ মাধ্যম লিখেছে (প্রথম আলো) সংগঠনগুলোর আপত্তির জায়গা বাদ দেওয়ার সুপারিশ তাঁর নিজেরও ছিল। কিন্তু সংসদীয় কমিটি থেকে যেভাবে এসেছে, সেভাবেই বিলটি সংসদে পাঠানো হয়েছে।
তবে প্রতিমন্ত্রী জানান, বিলের আপত্তির জায়গা নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংগঠনগুলোর সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে। তিনি সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথাও বলেছেন। এ ছাড়া তিনি বলেন, আইসিটি বিভাগের আরও সংস্থার অধীনে কোম্পানি আছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের কথা উল্লেখ করে বলেন, এগুলো মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে হয়েছে। এটুআইও যদি কোম্পানি করতে চায়, তবে সেটিও মন্ত্রিসভার অনুমোদনে হবে।
এখন দেখার বিষয় হলো সরকার কি ধরনের পদক্ষেপ নেয় এবং আইনটি অনুরুপভাবে বহাল থাকলে কার্যক্ষেত্রে আশঙ্কা কতটা সত্য হয়। এখনো পর্য্ন্ত আইনটি সংশোধন করে পাশ করার ব্যপারে যেমন কোনো আলামত পরিলক্ষিত হয়নি। তেমনি নতুন ক্ষমতা প্রাপ্তির ফলে এটুআই ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করবে তেমন ঘটনাও ঘটেনি। যদিও দুটো ক্ষেত্রেই বিষয়টি ক্রমশ ও সুদূর প্রসারী একটা ব্যাপার। তবে গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে এটুআই দ্বারা ব্যবসা সংগঠনের কিছু কথাবার্তা ভেসে আসছে। তবে সময়ই বলতে পারবে এর সঠিক বাস্তবায়ন কিভাবে হয়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন।
দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়েই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেই সংক্ষুবদ্ধ বা উদ্বেলিত হলে তা তার একান্ত বিষয়।